টইটম্বুর বলে একটা কথা আছে বাংলায়। কোত্থেকে উদ্ভব, জানিনা। এ’টুকু জানি, এর মানে বলে বুঝিয়ে দিতে হয় না কাউকে। টইটম্বুর শুনলেই বেশ একটা টইটম্বুর কিছুর কথা মনে পড়ে। চোখের সামনে দেখা যায়। কানায় কানায় ভর্তি বলা যেত, কিন্তু আদপেই সে’টা টইটম্বুর নয়। পেয়ালা ভর্তি চা পা টিপে টিপে না চলকিয়ে এনে অতিথির সামনের টেবিলে রাখতে গিয়ে সুরুৎ করে একটু সাদা টেবিলক্লথে। তাকে কি টইটম্বুর বলা চলে? উহুঁ। কিন্তু সেই চলকানোর পর এক ঘর পান-ক্ষয়াটে-দাঁত-ওলা খ্যাকখেকে হাসি বুলা জ্যেঠির গুষ্টির সামনে মা মুখ ঝামটা দিলে চোখ টইটম্বুর হয়ে ওঠে। সে’রকম চোখ আমি খুব চিনি। মুখ তোম্বা। নাক ঠাণ্ডা। কান লাল। একবার পলক পড়লেই হুড়মুড়িয়ে গালের কোল বেয়ে নামবে। “কাঁদছিস?” জিজ্ঞেস করলে শোনা যাবে না কিছু। মাথা নাড়া দেখা যাবে। “ঠিক ই তো। কাঁদতে তো তোর বয়েই গেছে।” হঠাৎ পকেটে হাত ঢুকিয়ে কী যেন খুঁজবে। নিজের না। আমার। বেয়াদপি। সহ্য হয় না। রুমাল নাড়া বিদায় বাসর সহ্য হয় না। যাবি তো যা না। টইটম্বুর তোর একার?
তারপর একদিন বৃষ্টি নামে। শীতের ঝোড়ো বৃষ্টি। ছাতাটাকে প্রায় মাটির সমান্তরাল করে ধরতে হয়, অদ্ভুত নাছোড়বান্দা কোণে জল নামে। উত্তররাগ আর পশ্চিমঘাটের উতরাই বেয়ে স্রোত। দুই টইটম্বুর নালায় দু’টো নৌকো। পাহাড়তলী যায়। হ্যাঁ, হ্যাঁ, উলটো স্রোতেই যায়। জানে না যেন! পাহাড়তলীতে বিরাট এক দিঘী। আমি রূপসায়রের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি। টইটম্বুর। উপচে পড়ে। আমার চোখে মুখে ঝাপটা লাগে। আঁজলা ভরে পান করি। তেষ্টা বেড়ে যায়। হাতের চেটোর উলটো দিক দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে বলি, আহ্। আমার কানের খুব কাছে ঠোঁট নিয়ে এসে তুই শুধোস, ও কীসের গন্ধ? জুনিপার। জুনিপার। তুমি চেনো না?
জুনিপারের গন্ধে নেবে চিনে, তোমার হদিশ লক্ষ আলাদিনে, বাড়িয়ে ধরা এক পেয়ালা জিনে, জিভ ছোঁয়ালে তরঙ্গ বিষম।
এই হয়েছে মুশকিল। আমার জানলায় পর্দা নেই। পাল্লা নেই। হাট করে খোলা। রাদ্দিন। রোদের ছাঁট ঢোকে। একফালি রেখাতে ধুলো কিলবিল করে। কখনও মেঘ। ঠেলেঠুলে গুঁতিয়ে ঠিক ঢুকে পড়ে। তারপর “আহ, হাল্কা হই” বলে আমার ঘর ভাসায়। টইটম্বুর।
ট্রেনটা যেন আমার বুকের উপর দিয়ে যায়।