দু’জন জাপানী দিদিমা পার্কের বেঞ্চিতে বসে গল্প করছেন। একজনই মূলত কথা বলছেন, অন্যজন সায় দিয়ে যাচ্ছেন এক দু’বাক্যে। তাঁরা কেবল বৃদ্ধাই হতে পারতেন, দিদিমা বলবার প্রয়োজন ছিল না। হয়ত বিয়ে করেননি দু’জনের একজনও। তাঁরা জাপানীও না-ই হতে পারেন। পূর্ব এশিয় চেহারা। তবু জাপানী দিদিমা কেন বললাম, সে’টা পরে বলছি।

আমি দিদিমাদ্বয়ের একটু দূরেই একটা চৌকো টেবিলে বসে খাচ্ছি। আর ভান করছি আমি একজন চাকরি যাওয়া বেকার। এ’রকম ভালো ভালো কল্পনা আমি করেই থাকি। সে’দিন ভাবছিলাম আমি লীড্‌স এর মাঠে স্টুয়ার্ট ব্রডকে পর পর দুই বলে চার মেরেছি। দু’টোই স্কোয়ার কাট। একটা ফ্রন্ট ফুটে। একটা ব্যাক। রবি শাস্ত্রী বিশ্লেষণ করছেন, ছেলেটা একই লেংথের দু’টো বল একবার ডীপ পয়েন্টের ডানদিকে, একবার বামদিকে খেলল। ডীপ এ দীর্ঘ ঈ দিলাম গভীরতা আনতে। যাই হোক, এখন আমি বেকার। চাকরিচ্যুত। বরখাস্ত। নতুন চাকরির দরখাস্ত চলছে। জুতোর শুকতলা ক্ষয়ে গেছে। বাড়িতে বাবামাস্ত্রী। কেউ জানেনা। আমি অফিসে যাওয়ার ব্যাগে খামোখা কাগজপত্র আর টিফিন নিয়ে বেরোই। আর একেকদিন একেকটা পার্কে বসে খাই। অফিসপাড়ায় হাঁটাহাঁটি করি। আসলে বাড়িতে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। বাড়িতে থেকে ভান করা যায় না। যত্ন নিয়ে একটা স্যান্ডউইচ বানিয়ে আর ফ্লাস্কে ল্যাক্টোজ-ফ্রি দুধের হট চকোলেট নিয়ে পার্কে এসেছি। আর দিদিমাদের বাক্যালাপ শুনছি। দু’টো শ্বেতাঙ্গ বাচ্চা ঝাঁপাঝাঁপি করছে। তাদের অভিভাবকদের দেখতে পাচ্ছি না। সোনালি কুকুরটা গায়ে ঘাস লেপছে। একটি স্বল্পবসনা মেয়ে দৌড়চ্ছে। কানে ইয়ারফোন। আমার ইচ্ছে করছে দাঁড় করিয়ে “কী গান শুনছ, শুনি?” বলে একটা কান কেড়ে নিয়ে নিজের কানে গুঁজতে। কান মানে মেয়েটার কান নয়। ইয়ারফোনের। জামার হাত থাকলে, প্যান্টের পা থাকলে, পকেটের বুক থাকলে ইয়ারফোনের ও কান আছে। যদিও হিসেব মতো ও’টা মুখ। শব্দ করে, শোনে তো না। শুনি আমরা। যাইহোক, ও কী গান শুনতে শুনতে অমন দৌড়োচ্ছে জানতে ইচ্ছে করছে। একটা আঁটসাঁট ছোট কমলা জামা। একটা ছোট্ট কালো প্যান্ট। সাহস হল না। আমায় তাড়া করলে তিরিশ সেকেণ্ডের মধ্যে পাকড়াও করবে। আমি পার্কের গেট অবধিও পৌঁছতে পারব না। এরা হেব্বি দৌড়য়। আমায় বাস ধরতে না হলে, বা বেপাড়ার কুকুরে তাড়া না করলে দৌড়োই না। মেয়েটা চলে গেল। আমি দিদিমাদের দিকে মনোযোগ ফেরালাম। তখনই বুঝতে পারলাম আমি দিব্যি ওদের কথাবার্তা বুঝতে পারছি।

ওদের একটা শ্যামদেশী বেড়াল আছে। নাতনির। সে’টি পালিয়েছে। অদ্ভুত দেখতে হয় বেড়ালগুলো। টিনটিনে দেখেছি। কুট্টুসকে তাড়া করত। নেস্টরের হাত থেকে প্লেট, বোতল পড়ে যেত, নেস্টর সার্কাসের কসরৎ দেখানোর মতো করে সেগুলো ফের পাকড়াত। বেড়াল নিখোঁজ। নাতনির মন খারাপ। ছেলের বৌ-টা ভালো হয়নি। মিসো স্যুপের উপর দিয়ে চালায়, র‍্যামেন যে’টা বানায়, মুখে দেওয়া যায় না। উত্তরে অন্য দিদিমা বললেন, তাঁর মেয়ে পর্কের সরু ফালি দিয়ে দিব্যি র‍্যামেন বানায়। অবান্তর কথাবার্তা। ছেলের-মা দিদিমা একটা লাল কটকটে জ্যাকেট পরেছেন। রূপোয় কালোয় চুল। কালো হাফহাতা জ্যাকেট মেয়ের-মা দিদিমা বললেন, মানিয়েছে ভালো। দুই দিদিমাই বিধবা। এবার দেশের কথা এল। দেশের বাড়ি। ছেলের-মা দিদিমার “কোথায় থাকতে যেন?” শুনে বুঝলাম এদের আলাপ নিতান্তই ক’দিনের। জানা গেল মেয়ের-মা দিদিমা মিয়াগিতে থাকেন। ফুকুশিমার থেকে খুব দূরে নয়। রেডিয়েশন বিভ্রাটের সময় আতঙ্কে ছিলেন। ছেলের-মা দিদিমা বললেন তাঁর বাপের বাড়ি টট্টরি তে, হিরোশিমার কাছে। আর বিয়ে করবার পর টোকিওর বাইরে, কানাগাওয়ায়। এইবার মেয়ের-মা দিদিমা সহসা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। “এই আমিও তো টট্টরির মেয়ে! আমার বাড়ি হামামোরি। তুমি কি একবার গরমের ছুটিতে এসেছিলে হামামোরিতে?” চুলোয় যাক বেকারত্ব। এদের গল্পটা অনেক বেশি ইয়ে। আমি ফোন বের করলাম। আঙুল টেনে টেনে জাপানের ম্যাপে জুম। টট্টরি একটা জেলা। আবার শহরও। আর হামামোরি সেই জেলারই আরেকটা শহর। সমুদ্রের পাশে। দুই দিদিমা চুপ। আমি রুদ্ধশ্বাসে হট চোকোলেটে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছি। খানিক পর মেয়ের-মা দিদিমা বললে, “তোমার নাতনির হুবহু তোমার মুখ পেয়েছে। কেটে বসানো। যেন কতজন্মের চেনা। তাই ভাবছিলাম অ্যাদ্দিন, কোথায় দেখেছি। এখন বুঝলাম।” আবার চুপ। আরে দিদা কী বুঝলে বলো? লাল জ্যাকেট কালো জ্যাকেটের হাত ধরে বললে, “স্যরি।” আরে! কেন? “খুকি ছিলাম তখন।” কালো জ্যাকেট মাথা নাড়লেন। হাসবার চেষ্টা করলেন। চোখে জল। আর ফুঁ দিলে হট চকোলেট বাঁশির মতো বেজে উঠবে। দুই বুড়ি এবার “চলো বাড়ি যাই” বলে উঠে গেলেন। ঊনসত্তরের গরমের ছুটিতে কী হয়েছিল, আমার আর জানা হল না।

মাপা রোদ। নিক্তি দিয়ে মাপা। তিরতির বাতাসের মধ্যে মধ্যে এক-আধটা দমকা। আমি অকারণ কোট পেন্টুল মায় টাই অবধি পরে হাঁটছি। এইসব খোলস এমনিতে ধরার সুযোগ হয় না। আজকে আমি সবাই-জানে-অফিস-গেছে-কিন্তু-আসলে-বেকার। এই নাটকের জন্য কোট-টাই ই কস্টিউম। আমার একটা ফেডোরা হ্যাট থাকলে ভান করতুম আমি তিরিশের দশকের নিউ ইয়র্কের বেকার। খানিকটা এই জামা কাপড়গুলো পরব বলেই এই নাটকের অবতারণা। আর ক’দিন গেলে প্যান্ট কোমরে আঁটবে না, কোট আটকে যাবে বগলের কাছে। সময় থাকতে পরে নিই, সুযোগ নিজেকে বানিয়ে নিতে হয়। আধ দামড়া কলেজ পড়ুয়াদের দল সসম্ভ্রমে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে। এই রঙচঙা হাফ পেন্টুলদের দলে কোট মানেই প্রফেসর। এরা তো আর জানে না আমি দাড়ি কামানোর মতো নিয়ম করে শিঙ ভাঙি। তাই এত বয়সেও বাছুরদের দলে থাকতে পারছি। বেশিদিন নয় আর। কোম্পানির লোকজন শিঙ পরীক্ষা করতে আসবে। আমি ভাবছি আমি জাপানী বুঝছি কী করে? পেটে জাপানী বোম ফেললেও তাকিওনা মুতেয়াসির থেকে বেশি কিছু বেরোবে না। তবে? জানিনা। আদৌ বুঝেছি, না কল্পনা? ডাউনটাউন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আরিগাতোর সামনে পৌঁছলাম। সুশির দোকান। বাহারী দোকান। বাইরের কাচে মেনু সাঁটানো। ইংরেজীর পাশাপাশি খুদে জাপানী অক্ষর। পড়তে পারছি। কিন্তু তাতে কিছু প্রমাণ হয় না। তলায় ইংরেজিতে ওইসবই লেখা। ঝাঁপছি না কে বলল? আচ্ছা, জাপানী কি বলতে পারি? ভিতরে কালো জামা নীল মুখোশ মেয়েটাকে কিছু বলব জাপানীতে? ইচ্ছে করল না। হাঁটতে ইচ্ছে করছে। কচি শহর বাড়ছে। এই তো বাড়ার বয়স। কত কত নতুন বাড়িটাড়ি হচ্ছে। উঁচু। তাদের শেষ দেখা হবে না আমার। নিজেকে ওয়াজিদ আলি শাহ মনে হচ্ছে। রাজ্যপাটে আগ্রহ নেই, অথচ লখনৌ বড় প্রিয়। লাইব্রেরী থেকে অমল গুনগুন করছে। টাঙ্গার উপর থেকে ফেলুদা। মুখে শেষ বেলার রোদ নিয়ে ওয়াজিদবেশী আমজাদ খান। যব ছোড় চলে লখনৌ নগরী…

এমন কত অজস্র লখনৌ আছে পৃথিবী জুড়ে। কত অজস্র ওয়াজেদ আলি শাহ। টট্টরির দিদিমারা। পাইনহাটার ইলতুৎমিশ। দিন শেষ হতে যায়। অফিসফেরতা ক্লান্ত বাবুটির মতো বাড়ির রাস্তা ধরি। যেখানে বাবামাস্ত্রী নেই। নাটকে যবনিকা।