জানিস, ডিলেমা শব্দটার বাঙলা অভিধান বলছে উভয়সঙ্কট। অথচ শব্দটার আরও গভীর, আরও সূক্ষ্ম একটা মানে আছে। মানেটা তুই জানিস, সে’টা আমি জানি। অনুভূতিটা সময়গুলোকে দুর্বোধ্য, অমোঘ গিঁটে পেঁচিয়ে ফেলে। অনুভূতিটা আরও তীব্র, আরও গাঢ় করে তোলে চাওয়াগুলো। তুই জানিস। আমি জানি।

 

সম্পর্কগুলো কোথাও একটা এসে পূর্ণতা পেয়ে যায়। পরিচিতিতে, ভরসায়। অপেক্ষার অবসানে। সেইখানেই গল্পগুলো, সিনেমাগুলো শেষ হয়ে যায়। কিন্তু জীবন বাকি থাকে অনেকখানি। একটা ভীষণ ক্লান্তিময় বিকেল; কাদা-ছেটা; ঈশ জামাটা পুরো ভিজে গেছে, মোজাটাও; মাথাটা ধরেছে খুব-এর পর একটু বাড়ি ফেরা আদা চা; রঙচটা ন্যাকড়া জামার বুকে মুখ গুঁজে চুপ থাকা। অম্রুতাঞ্জনের রিনরিনে কিন্তু স্পষ্ট গন্ধ লেগে থাকা কপালে, রগে, তর্জনী আর মধ্যমায়। সারা ঘরে। বালিশে। চাদরে। “কাল অফিস যাস না, প্লিজ?” নীরব ঘাড় নাড়া। অসমাপ্ত হাসি। “একটু ঘুমোই। দু’ঘন্টা পর ডেকে দিবি?” বাকি থেকে যায় জীবন। নিশ্চয়তায়।

 

তারপর হঠাৎ কখন ডিলেমা এসে ঝাঁকিয়ে জাগিয়ে দেয়, না? তিন দিকে দেওয়াল তুলে একটা ছোট্ট ঘর বানায়, ভিতরে আসতে বলে। অলক্ষ্য প্রশ্রয়। কুণ্ঠা, অনুমতি। একটা ঘুমন্ত শরীরের পাশে শুয়ে ভারী পর্দা ঠেলা বৃষ্টিশেষের হাওয়া। ও ঘুমোচ্ছে, ঘুমোক, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। সন্তুরের গৎ, লো ভল্যুম। প্রশ্রয়। ঠাণ্ডা লাগতে পারে, তবু, বড় ভালো লাগায় হাওয়াটা। জোলো হাওয়া। শিরশিরানি। অপরাধবোধের বুদ্বুদ। হাতের রোম দাঁড়ানো। মানুষটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। গাছের মাথা ধোয়া উচ্ছিষ্ট জল মুখে চোখে এসে পড়ে। হাসি পায়। “সিগারেট আনতে যাচ্ছি। যাবি?” যাবো। অপ্রয়োজন। অদরকারী। তবু… প্রশ্রয়। ভেজা পাতা মুখের খুব কাছাকাছি এসে যায় হঠাৎ। এগিয়ে মুখ ভিজিয়ে নিতে কুণ্ঠা। ঘুরিয়ে মুখ সরিয়ে নিতে অনিচ্ছে। ডিলেমা। রোদ উঠে যাবে, জানি কাল। শ্রাবণের বর্ষা তো নয়, শেষ জৈষ্ঠের অতিথি। তাতে দুঃখ নেই। তবু। গাঢ় সবুজ পাতা আর রাধাচূড়া লেপ্টানো পায়ের পাতা ভেজা কালো পিচের রাস্তা। এগোতে ইচ্ছে করে। লাভ ক্ষতির আঁক কষতে ইচ্ছে করে না। ঘাড়ে, ঠোঁটে এসে পড়া ফোঁটা মুছতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে না, তবু… এই তবুটা বঁটিতে ধার দেওয়ার মত কিরকির করে কানের কাছে। এই তবুটাই ইচ্ছেটা বাড়িয়ে দেয়। উফ! কান্না পায় তোর? কান্না পায়।

 

কাঁদিস না। এগিয়ে যাস। খালি পায়ে। ভুরু থেকে গড়িয়ে পড়া ধারাটা মুছিস না। সরাস না হাত। বা ঠোঁট। শীত করলে, আঙুলের ডগাগুলো ভিজে কুঁচকে গেলে এসে শুয়ে পড়িস ঘুমন্ত মানুষটার পাশে। ঠাণ্ডা লাগার আগে তোয়ালে দিয়ে দিয়ে চুল শুকিয়ে নিস। তোয়ালেতে ঘুমন্ত একটা মানুষের গন্ধ? কখনও কখনও বর্ষাসিক্তা আর সদ্যস্নাতার মধ্যে তফাত করা যায় না। শুধু তোয়ালে জানে।

 

তারপরে আধাভিজে চুল নিয়ে লোকটার ঘুম ভাঙিয়ে বলিস, “একটা স্বপ্ন দেখলাম, জানিস?”