চাবিটা বাঁ দিকে ঘোরাতেই দেওয়ালের গায়ে লাগানো সরু ডালাটা খুলে একগাদা খাম হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো, ইস্কুলের শেষ ঘন্টার পরের ছেলেপিলেদের মত। খামেন পরিচয়তেঃ। ব্যাঙ্কের চিঠি। স্টেটমেন্ট। মাসের শেষের সাড়ে আট আনার হিসেব। ময়লার বালতিতে। ইন্স্যুরেন্স এর নোটিস। সুনিপুণ ভাবে তারা মাইনে থেকে এক কামড় খেয়ে নিয়েছে। গুচ্ছের ক্রেডিট কার্ডের বিজ্ঞাপন। তাদের কার্ড নিলে তারা মাইনাস দু’শো তিয়াত্তর শতাংশ সুদে আমায় টাকা ধার করতে দেবে। শর্ত সাপেক্ষে। পাড়ার কাছে একটা স্যান্ডউইচ এর দোকান খুলেছে। তারা হোম ডেলিভারি দেয়। বেশ। তাকের উপর থাক। রাতেবিরেতে…

একটা গোলাপি খাম। গোলাপি। টুকটুকে গোলাপি। হ্যালো কিটির স্টিকার সাঁটা। নাম লেখা কেটি বার্গম্যান। ভালো করে ভাবলাম। সন্দেহ গেল না। ওয়ালেট থেকে পরিচয়পত্র বের করে দেখলাম। নাহ্‌, আমার নাম কেটি বার্গম্যান নয়। তবে ঠিকানা নিয্যস আমার। ‘পোস্টাপিসের সিগনাল থেকে সোজা এগিয়ে গিয়ে সমুদের বাড়ি পেরিয়ে প্রথম ডানহাতের গলি দিয়ে ঢুকে ম্যাগনোলিয়া গাছের পাশে লাল ইঁটের যে দোতলা বাড়িটা, তার একতলার বাঁ দিকের ঘরটা’। আমারই ঠিকানা। চিঠিওলা ভুল করেনি। দরজার বাইরেই খালি মেঝেতে বসে পড়লাম। কেটি বার্গম্যান। দলিলপত্র না ঘেঁটে নিশ্চিত হওয়া যাবে না, কিন্তু আমার সহবাসিন্দাটির নাম খুব সম্ভব অঞ্জন দত্ত। তাকে অবিশ্বাস করার কোনও কারণ হয়নি এযাবৎ, কিন্তু পৃথিবীতে কত কিছুই তো হয়। কাউকে বিশ্বাস নেই। তার উপর দার্জিলিং এর অশান্তি তে ওর প্রতিক্রিয়া জিজ্ঞেস করাতে সে বলল “সময় থাকতে ঘুরে আসা উচিৎ ছিলো।” বোঝো। ওর অনুপস্থিতিতে ওর ঘরে উঁকি মেরেও দেখেছি। গিটার চোখে পড়েনি, নতুন পুরোনো কোনও রকমই। তবে হ্যাঁ। সিগারেটটা প্রচুর খায়। তা এ হেন, স্ফীতোদর অঞ্জন এর আসল নাম কেটি বার্গম্যান নয় তা কে বলতে পারে? ক্যাথরিন যদি কেটি হয়, ক্রিস্টফারের কেটি হতে আপত্তি কোথায়? ইঙ্গমার কি ইঙ্গরিড কারো…

চিঠিটা তাকে তুলে ধ্যার ছাই বলে চলে আসব ভেবেছিলাম। পারলাম না। পেটরোগা বাঙালি। দেখো না বললে চশমা ছাড়া হলেও চোখ কুঁচকে দেখা চাই। ছোটবেলায় “এ’সব বড়দের” বলে একটা বইএর তাক ছিলো। সেই তাকে আমার তাক ছিলো। তার একটিতে কেবল মোজা পরিহিতা এক নারীর বিন্যাস করা ছিলো আড়াই পাতা ধরে। গভীর মনোযোগে পুরোটা পড়ে রোববার দুপুরে খেতে বসা জনা কয়েক আত্মীয়ের সামনে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম উলঙ্গ মানে। তাকে চাবি পড়েছিলো সেইদিন। জন্মজন্মান্তরের অভ্যাস। চুলকুনি। করিডোর দিয়ে হেঁটে যাবার সময় খোলা দরজা থাকলে চোখ টানবেই। অবধারিত! পাশের সিটে বসে কেউ মোবাইল ঘাঁটলে আলগোছে আড়চোখ। বড় অবাধ্য সব। তাই চারপা গিয়ে গোলাপি হ্যালো কিটি খামটা নামালাম। আমার ঠিকানা। আমার কি কোনও অধিকার নেই? কেটি বার্গম্যান কে পাঠানো গোলাপি খামটা খুলে ফেললাম। একটা কার্ড বেরোলো। রঙচঙা কার্ড। গোলাপির প্রাধান্য বেশি, বাকিদের জামানত বাজেয়াপ্ত, কিন্তু অনুপস্থিত নয়। খুললাম।

আদরের নাতনি,

কত্ত বড়টি হয়ে গেছ, কে জানে? তোমার বাবা তোমায় তোমার অনেক দূরের দাদু ঠাম্মার গল্প বলে? আমাদের কেউ বলেনা তোমার গল্প। তোমার আজ জন্মদিন, কেটিসোনা, তুমি এখানে এলে ঠাম্মা ব্লুবেরী পাই বানাতো তোমার জন্য, রাস্পবেরী মাফিন। ওই মোটা চশমা পরে তোমার যে ছবিখানা আছে, আমার কোলে? ওই চশমাটা তোমার ঠাম্মার। সে চশমা পরে ঠাম্মা তোমার কার্ডিগান বুনেছে একটা। সে কি আর তোমার গায়ে হবে? কত্ত বড় হয়ে গেছ, কে জানে?

শুভ জন্মদিন, কেটি। আরো অনেক অনেক বার এই দিনটা ফিরে আসুক তোমার জীবনে। খুব আনন্দ করো, কেমন?

দাদু আর ঠাম্মা।

ঝাপসা ভাবটা কাটার পর প্রেরকের ঠিকানা দেখলাম নিউ মেক্সিকো। কেটি নিশ্চই আমি আসার আগে এখানে থাকত, এখন অন্য কোথাও। দাদু জানে না। কাল পোস্টাপিসে যাবো। নয়ত বাড়িওলার বাড়ি। কেউ না কেউ জানবে দাদু কোথায় গেলে কেটি কে পাবেন।