এক ধরণের অনিবার্য ঘুম হয়, সাময়িক মৃত্যুর মতো। রাত্রিবেলা জলের বোতল মাথার কাছে রেখে দাঁত মেজে আলো নিভিয়ে কম্বলের তলার গুটিশুটি তার কাছে নস্যি। সে ঘুম কোমরবন্ধ খোলবার অবকাশ দেয় না। চশমা চাপা পড়ে পেটের তলায়। আকাশি জিন্স আর বাইরের জামা পরে পায়ে কুড়ুল খেয়ে ধুপ করে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই পড়ে ঘুমিয়ে গেল ইলতুৎমিশ। বেলা চারটের রোদ লাল পর্দার রঙ চুরি করে গোটা ঘরটা মায়াময় করে তুলেছে। দরজা খুললে চরিত্রহীন চৈত্রের রোদ, আগল দিলে ঝিমঝিমে শীতলতা। ত্রিভঙ্গমুরারী হয়ে একটা দেড় মণি লাশ পড়ে থাকে বিছানায়, তেরছা হয়ে। হাতের ঘড়ি দাগ কেটে বসে। মুখ হাঁ। কী’সব গড়িয়ে পড়ে বালিশে। এক যুগ আগেও এ’রকম ঘুম আসত। অসিযুদ্ধের ক্লাস শেষ হত একটায়। দু’টো থেকে চক্রব্যূহ স্ট্র্যাটেজি। ডিএ’র ক্লাস। মাঝের একঘন্টায় ক্যান্টিনে গিয়ে ডিমভাত খেত ইলতুৎমিশ আর অভিমন্যু। ডাল, কাঁচালঙ্কা, কাঁচা পেঁয়াজ, ডিমের ঝোল। পিঁপে থেকে জগে করে জল নিয়ে কুলকুচি করে মুখে চোখে চুলে জল দিত। তারপর ক্লাসে গিয়ে বেঞ্চিতে বসে টেবিলে দু’হাত আড়াআড়ি রেখে মাথা নামালেই অন্ধকার। সেই ক্লাসটা ফেল করেছিল দু’জনেই।

এই ঘুমের সঙ্গে প্রথম পরিচয় আরও আগে। টোল থেকে ফিরে ধুম জ্বর। গরমকালের জ্বর। সিজন চেঞ্জের জ্বর নয়। চোখ লাল। কান থেকে ধোঁয়া। পারা ছাপিয়ে চড়চড় করে উঠছে মায়ের টেনশন। তেতেপুড়ে বাড়ি ঢুকেই ফ্রিজের জল? কে জানে। রূপোলি রাংতা থেকে হাতে নেমে এলো প্যারাসিটামল। হোমিওপ্যাথি ঠুসে বড় হওয়া ইলতুৎমিশ পাশবালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঠাম্মা একেবারে ঠোঁটের কাছে মাথা নিয়ে গিয়ে শুনেছিল সে বলছে প্যারা… প্যারা… প্যারা… সে প্যারা সিটামলের নাকি ডাইসের তা শুরুতে বোধগম্য হয়নি। তার খানিক পর ব্যাপারটা স্পষ্ট হল। প্যারাডাইস ই বটে। স্বর্গদ্বারের প্যাঁড়া। জগন্নাথের প্যারা। কাকাইরা পুরী ঘুরে এসেছে বটে। ইলতুৎ মিস করে গেছে। পরীক্ষা। বাঁশছালের টুকরিতে করে প্যাঁড়া ফেরত এসেছে কেবল।

 

সাড়ে সাতটা নাগাদ সাড় ফেরে। মুখের নাল মুছে অন্ধকার ঘরে উঠে বসে ছেলেটা। বাইরে পুরো অন্ধকার হয়নি তখনও। বিশ্বজোড়া কালোতে একটা আয়তাকার জানলা স্পষ্ট হয়ে আছে। জানলাটা এবার কাছে আসতে থাকে। ঘরটা ছোট হচ্ছে নাকি? হুরিবাবা! গায়ের জোরে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। এ’টা কোথায়? কার ঘর? হাওয়া কমছে নাকি ঘরে? লাফিয়ে উঠে পায়ে পায়ে দরজার কাছে গিয়ে ছিটকিনি খোলে ফটিক। হাতল ঘুরিয়ে টানে। দিনশেষের বাড়তি আলো। সমস্ত ওলটপালট হয়ে আছে। লম্বা টানা বারান্দা। এক মুখে সিঁড়ি। সিঁড়ির গায়ে পাঁচিল। পাঁচিলে উঠে বসে ফটিক। নিজের হাত পা চামড়া সব অচেনা ঠেকে। পশ্চিম গ্লেন অ্যাভিন্যু দিয়ে একটা পুলিশের গাড়ি লাল নীল আলো জ্বালিয়ে বেরিয়ে যায়। অবার্নপুর জুড়ে ফাল্গুনী শৈত্য। কালো গাড়িগুলো হলুদ হয়ে আছে ফুলের রেণু জমে। এ’সময়টায় অ্যালাবামা জুড়ে খুব পোলেনের উৎপাত। ফটিক শুনতে পায়, অগ্রণী ক্লাব থেকে মাইকে হিন্দি গান বাজছে। ও মেরি জান। অচেনা বুকের ভিতর থেকে বুদবুদ উঠতে থাকে। একটা পঁয়ত্রিশ মিমি ক্যামেরার শব্দহীন সিনেমা। মা বাদাম ভাজা দিয়ে চিঁড়ের পোলাউ বানিয়েছে। খবর দেখতে দেখতে খাবে। তারপর পড়তে বসবে।

 

“ঘরে আসবি না, ইলতু?”
চমক ভাঙে ফটিকের।
“হ্যাঁ। যাই।”
সমস্ত পাঁচমিশেলি অচেনার মধ্যে একটা চেনা মুখ বড় স্বস্তি দেয়।
“এ’রম করে বাইরে বসে আছিস কেন থম মেরে?”
এই মুখটা ফটিক চেনে। এই মুখটা চেনে ইলতুৎমিশ।
হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে বারবার শান্তি হয়ে ধরা দেয় ইবন বতুতা।

“এইত্তো। আসছি।”