জায়গাটার নাম অছিপুর। ম্যাড়মেড়ে। পানসে। স্যাঁতসেঁতে। বৃষ্টি তেমন পড়ে না, কিন্তু বাইরে বেরোলে চোখে নাকে ভিজে ভিজে ঠেকে। সবুজ চাদরটা মাথার উপর দিয়ে জড়িয়ে হোঁচট খেতে খেতে হাঁটছিল বিশালাক্ষী। বড্ড শ্যাওলা, উঠোনটুকু পেরোতেই এক যুগ পেরিয়ে যায়। একটা নোনতা, সোঁদা গন্ধ মাথা ধরে রাখে। একটু চা পাওয়া যায় কোথাও?
বাইরে বাজারটা সরগরম। উচ্ছ্বল ব্যস্ততা। কুয়াশাটা পাতলা হয়, চড়া আলোয়। চড়া। সবকিছুই বড় চড়া, এই অছিপুরে। শব্দ, রঙ, গন্ধ। নৌকো থেকে নেমে এক পাড় কাদার মধ্যে গোড়ালি ডুবিয়ে নৌকোটাকে ফিরে যেতে দেখেছিল বিশালাক্ষী। অছিপুরের আর্দ্রতায় আরও দু’ফোঁটা যোগ করেছিল সে। দু’টো মেয়ে কাঁধে ধাক্কা দিয়ে তাকে পেরিয়ে গেল। টাল সামলে নিল সে। একপ্রকার অদৃশ্যই সে অছিপুরে। যে মালাওলাটা চড়া সুরে হেঁকে ফিরি করে, পথচলতি সবকটা মেয়ের হাতে রজনীগন্ধার বালা পড়িয়ে দেয়, রসিয়ে কথা বলে বেশ, জুঁই এর খোঁপা বেচে চড়া দামে, টগরের গোছ নেড়েচেড়ে দেখবার সময়ও ফিরে চায়নি বিশালাক্ষীর দিকে। ছিটেফোঁটার সম্ভবনা আসন্ন হয়। এক গেলাস চা পাওয়া যেত কোথাও?
চা ছিল ঘরে। মিহি গুঁড়ো, তেজী দানা আর তাজা পাতা মেশানো, সমানুপাতে। খানিক্ষণের জন্য হলেও নোনা বাতাস ছুটি নিত সে চা ফুটলে। কেটলিটা শোঁশোঁ করত। বিশালাক্ষী অদৃশ্য, তার কন্ঠ অশ্রাব্য, কিন্তু তার চা অঘ্রাণ্য নয়। দুই টুকরো এলাচ পড়ে আছে শুধু, “নিলাম”টুকুও বলেনি কেউ। তাই বাজার। কী একটা পরব চলছে। চড়া আতরে ঝিমঝিম করছে চত্বর। সরে আসে বিশালাক্ষী। অন্ধকারে। আড়ালে। ফারাক কই?
মন্দিরের চাতালটা খালি আজ। এইদিকটায় কেউ বড় আসে না। মাথায় তিলক কাটা গোঁয়ারগোবিন্দ পুরুতটাও নেই এখন। থামে হেলান দিয়ে বসে বিশালাক্ষী। এই আসনটা বুড়ো রুবাবওলাটার। সামনে রুমাল পেতে তিন চারটে সুর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাজাতে থাকে সে। ভালো লাগে। বাজনা থামিয়ে দু’একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে সে। বিশালাক্ষীকে সে দেখতে পায়। বাজারে রয়েছে রুবাবওলা আজ। পুরুতটাও মন্দ না। খিটখিটে, তবু… পানের খিলি সাজিয়ে রাখে বিশালাক্ষীর জন্য। বিশালাক্ষী হাঁটুর উপর মুখ গুঁজে বসে। কপালে শিশির জমে। পান চাই না। একটু চা…
অছিপুরের মোহনায় চড়া পড়ে। নাব্যতা শূন্য, নৌকো ঢুকবে কেমন করে? বিশালাক্ষী, জোয়ার আসবে কবে?