কতদিন হল এই জরুরী অবস্থার? জানিনা। মনে নেই। হিসেব নেই। গুনছি না। দিব্যি আছি। কেমন করে আছি, জানিনা, কিন্তু দিব্যি আছি। খুব যে বেরোতে ইচ্ছে করছে, তা নয়। খুব যে কারুর সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে করছে, কথা বলতে ইচ্ছে করছে, তা-ও নয়। সে’টা ভালো না খারাপ, জানিনা, কিন্তু আমার গত পাঁচ বছরের খোলসবন্দী জীবন আমাকে এই জরুরী অবস্থার জন্য তৈরী করে রেখেছে। এক আধটা ইচ্ছে হয়, গোপন ইচ্ছে, নিংড়ে নেয়। কিন্তু সেই ইচ্ছের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চলছে। সে আছে আমি জানি, বিদ্যমান, কিন্তু তাকে তাড়াচ্ছি না। সে থাকুক। তার থাকা প্রয়োজন। সে না থাকলে আমি হারিয়ে যাবো, আর কেউ কোনওদিন আমায় খুঁজে পাবে না।  যে কোনও দুর্ঘটনার অনেকগুলো স্তর থাকে, যাকে হুল ফোটায়, তার মনে। তার প্রথমটা ভেঙে পড়া, তারপরেরটা অস্বীকার করা, তারপর মেনে নেওয়া। তৃতীয় স্তরে বহু বহুদিন আগে পৌঁছে গেছি। এখন উনুনের পাশে দাঁড়িয়ে খেতে খেতে ফিল্টারে জল ভরা দেখি। উপরের বাক্স থেকে নীচের বাক্সে চুঁইয়ে জল পড়ে। বালিঘড়ির মতন। দু’দিন অন্তর ঘর পরিষ্কার করি। বাইএর গিয়ে দাঁড়াই। পায়ে রোদ মাখি। রেলিঙের ওধারে গাছে নতুন পাতা এসেছে। পুরোনো গাঢ় সবুজ পাতা আর নতুনের কচি সবুজের বৈষম্য দেখতে খুব ভালো লাগে। ক’দিন হল আকাশটাও খুব নীল হয়ে আছে।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা বারান্দা। করিডোর। একধারে রেলিঙ, অন্যধারে সারি সারি ঘর। ছ’টা। তার তৃতীয়টা আমার। একধারে এক বাংলাদেশী দম্পতি, অন্যধারে এক নেপালি দম্পতি। তাদের একটি জুঁইয়ের মতো মিষ্টি মেয়ে। এক বছর ও হয়নি। তলার পাটির দু’টো দাঁত বের করে হাসে। আমার চশমা ধরে টানে। আজ আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সেও তার মায়ের কোলে তাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। লাফ দেবার চেষ্টা করছে। মাকে ঠেলছে। দু’হাত বাড়িয়ে আমার কাছে আসবে। এইরকম দু’হাত বাড়িয়ে কাছে টানার ভঙ্গিটা খুব চেনা। খুব প্রিয়। যেতে পারলাম না। গেলাম না। উচিৎ না। আর ক’টা দিন, হ্যাঁ? তারপর খুব আদর। এ’রকম কথা হয়ে আছে। ওয়ান ডে অ্যাট এ টাইম। দিনপ্রতি এক দিন। জুঁইকে দেখে একটা উপলব্ধি হল। তার মা বলেছিল আমি দেওয়ালে হেলান দিয়ে বাঁশি বাজালে তাদের ঘর থেকে শোনা যায়। জুঁই শোনে। আর খিলখিলিয়ে হাসে। সে রাতে না ঘুমোলে দেওয়ালে তাই টোকা পড়ে আজকাল। আমি বিশ্বাস করিনি। পরখ করতে চেয়েছিলাম। কথা সত্যি। তার সামনে দাঁড়িয়ে এক লড়কি কো দেখা তো বাজিয়েছি, সে রীতিমতো শব্দ করে হেসেছে। আমার খুব ভালো লেগেছে। আজ তাকে কোলে নিতে পারলাম না। এ’কদিন পারব না। উপলব্ধিটা একটু দুঃখের। আমার চারপাশে শেষ কয়েকমাসে বেশ ক’টি শিশু জন্মেছে। তাদের মধ্যে দুইজন খুবই প্রিয় মানুষদের সন্তান। একটি ছেলে, একটি মেয়ে। মেয়েটির দিদা এসে রয়েছেন, ছেলেটির দাদু, দিদা, দু’জনই। চারপাশের সহকর্মী, বন্ধুরা আত্মীয়ের মতো ঘিরে রয়েছেন পরিবার দু’টিকে। আমরা কাকু, মামা, পিসী, মাসি হয়ে গেছি। দেশে যেমন হয়, এখানে ঠিক তেমনই অনাত্মীয়, এক বছরের পরিচয়ের মানুষজন পরম আত্মীয়তা পাতিয়েছেন। শিশুগুলি, তাদের বাবা মা ভাগ্যবান। জুঁই ততো ভাগ্যবতী নয়। তার দিদা এসে ছিলেন কিছুদিন। খুব অল্প সময়। সে জন্মাবার ঠিক পরে পরেই এসেছিলেন। অনেক দিন হল। জুঁই কে রোদে পেতে সর্ষের তেল মালিশ করতেন। আমার চোখ জুড়িয়ে যেত। তাদের ছবি তুলে উপহার দিয়েছি। জুঁইয়ের হয়ত মনেও নেই সেই দিদার কথা। কিন্তু সেই পর্যন্তই। আজ অবধি আর কাউকে তাদের বাড়ি আসতে দেখিনি। উপহার নিয়ে নয়, আদর নিয়ে নয়। ছোট্ট জুঁইয়ের ওই ঘরটা, বারান্দাটাই জগৎ। আর সেই জগতে আর দু’টি মাত্র মানুষ। আজ মনে হল সেই ছোট্ট পৃথিবীতে আমারও অভিষেক হয়েছে। থাকবার ছাড়পত্র মিলেছে। জুঁই আমাকে চেনে। আমার কাছে আসতে চায়, তার চেয়েও বড়, সে আমায় চিনতে পারে। ঠিক কেন যে এই ব্যাপারটা এত বড় প্রাপ্তির মতো লাগে, উদ্ধার করতে পারিনি। একদল গাঢ় সবুজ মানুষের মধ্যে ওই একটা কচি কলাপাতা মানুষ আমার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে।

অনেকে একে অপরকে জিজ্ঞেস করছে এই বন্দীদশা ঘুচলে তারা কী করবে। বাইরে খেতে যাবে। ঘুরতে যাবে। কাজে যাবে।

আমি বাড়ি যেতে চাই।