বাবা শোবার ঘরের আলমারি খুলেছে। দরজার গায়ে চাবি ঝুলছে, দুলছে। ইস্পাতে ইস্পাতে শব্দ হচ্ছে। ঠুনুক ঠুন। একদম উপরের তাকে গরম জামা থাকে। সোয়েটার, মাফলার, পশম টুপি, ন্যাপথলিন। মায়ের কিছু দামী শাড়ি। সেই স্তূপের তলায় হাতড়ালে একটা ছোট্ট চাবি পাওয়া যায়। লকারের। আমি খাবার ঘর থেকে দেখছি। আর দই চিঁড়ে খাচ্ছি। রবিবার। দই চিঁড়ে। খবরের কাগজে বুদ্ধদেববাবুর ছবির উপর গোল হয়ে ভিজে বাটির তলার ছাপ পড়েছে। মা লাউ এর খোসা ছাড়াচ্ছে। একটু পর আমার খোসা ছাড়ানো হবে।
**********************************************************
মা আমাকে ভোরবেলা করে ইঁটখোলার পুকুরে নিয়ে যেত। সে অনেককাল আগেকার কথা। যখন বাজপেয়ী সরকার লিখত আনন্দবাজারে, আর আমি ভাবতাম আমাদের প্রধানমন্ত্রী বাঙালি। যাকগে, মা কেমন সৎ-মা মার্কা রূপ ধরে জলে ঠেলে ফেলে দিত আমায়। পুকুরে কিছু নীল লুঙ্গি, মুখে-টুথব্রাশ প্রিডেটর আমায় লুফে নিত। চশমা পরে জলে নামা যায়না। তায় চোখে পিচুটি। আমার জলবাস খুব অসহায়। আবছা-মা পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকত। আমি আমপান্না রঙের শ্যাওলা-জল আর খাবি খেতাম। এই একটা মজা হয়েছে। পাড়ার কিছু কাকু আপিস যাবার আগে ইঁটখোলা পুকুরে নাইতে যেত লুঙ্গি পরে। পিছল সিঁড়িতে হাওয়াই চটির পাশে লাইফবয়ের খোসা আর ক্লিনিক প্লাসের পাতা পড়ে থাকত। তাঁরা ভুল উচ্চারণে অং বং সূর্য্যপ্রণাম সেরে ডুব দিতেন। লুঙ্গি কোমরের কাছে ভাসত। তো পাড়ার কোন মাতব্বর বুদ্ধি দিল, এক কাজ করুন না, এই সময়টায় পাড়ার বাচ্চা গুলোকে সাঁতার শিখিয়ে দিন। ব্যস। তাঁরা নামমাত্র অর্থে ইঁটখোলা কলরবলর এ ভরিয়ে তুললেন। আমি দিব্যি পাড় ঘেঁষে সমান্তরাল সাঁতরাতুম, সহ্য হল না। সোয়া-পুকুর অবধি গিয়ে মিত্র কাকু যীশুর মত ভাসতেন, আমাকে তাঁর কাছে ছুপুৎ ছপাৎ করে যেতে হত, ভয়ে ভয়ে। তারপর তড়িঘরি পাড়ে ফেরা। একদিন দেখি একটা মস্ত টিউব জোগাড় হয়েছে। আমি তার একদিক ধরে আছি, আর মিত্তিরমহাশয় আমাকে শুদ্ধু টিউব টানতে টানতে মাঝ-সমুদ্দুর। তারপর মই কেড়ে নেবার মত বেমালুম হাওয়া। আমি রাগে, অভিমানে, ভয়ে, বিশ্বাসহত হয়ে এক পেট জল খেয়ে পাড়ে। এ না হলে নাকি আমার ভয় কাটত না।
যাই হোক, ক’দিন আগে রাত্তিরে এ’কথা সে’কথায় বাবা খুব ছাতি ফুলিয়ে ঘোষণা করল সাঁতার শেখা মোটেই কঠিন কিছু না, বাবা এই বয়সেও দিব্যি তা শিখে নেবে কেউ শেখালে। মা খামোখা টোন কেটে বলল, “তা ছেলে তো ধামড়া হয়েছে। সেই শেখাতে পারে।” সেই হল কাল। হুকুম হল, পরদিন সকাল থেকে ফের ইঁটখোলা। মা বেগতিক দেখে “শিং ভেঙে যাবে” বলে সামাল দেবার চেষ্টা করল বটে, কিন্তু কাজ দিল না তাতে। বাবা পুকুরে নামল ক’দিন। শ্বাস নেওয়া ছাড়া, ডুবে ডুবে জল খাওয়া, এলোপাথাড়ি হাত চালানো, ফেনা তুলে পা ছোঁড়া, এ’সব লোকটা দিব্যি আয়ত্ত করে নিল। আমার শিক্ষক হিসেবে হাল্কা ঘ্যাম হওয়া শুরু হয়েছে। “এই বারে জলে পেয়েছি লোকটাকে, এখানে বাবা আমার হুকুমমতো ঘাড় নাড়াবে।” আজ সকালে মনে হল এবার একটা সারপ্রাইজ টেস্ট নেওয়া দরকার। মিত্রকাকু কায়দায় সিঁড়ি থেকে একটু এগিয়েই জলের তলায় সাইকেল চালিয়ে ভেসে রইলাম। বাবা কে বললাম, “ইঁয়াহা পে আও।” আবছা-বাবা তুমুল জল ছিটকিয়ে পুকুরশুদ্ধু মাছের পিলে চমকিয়ে আমার কাছে এলো। আমি অল্প অল্প পিছোচ্ছি। বাবা একটা আকাট কুমীরের মতো এগোচ্ছে। ডেভিড অ্যাটেনবরো থাকলে কী’রকম রোমহর্ষক বর্ণনা দিতেন, তাই ভাবছি, এমন সময় বাবা আমায় ছুঁয়ে ফেলল। আমি আদেশ দিলাম, এবার ঘুরে যাও, সিঁড়ি অবধি। বাবা এক সেকেন্ডের কিছু ভগ্নাংশের জন্য প্রবল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম, ছড়িয়েছি। জলের মধ্যে দিক পরিবর্তন করাটা শেখানো হয়নি। আউট অফ সিলেবাস প্রশ্ন করে ফেলেছি। বাবা ফেল করবে।
ভগ্নাংশটা মুহূর্তে ত্রৈরাশিক হয়ে গেল। বাবা রাশি রাশি জল ছড়িয়ে গ্লাবডুব করে এক জায়গায় হাত পা ছুঁড়তে লাগল। সিঁড়িতে কিছু নব্য-কাকু রগড় দেখছিল। রোজ ই দেখে। তাদের ই একজন এগিয়ে এসে বাবার হাফ-প্যান্ট ধরে টেনে সিঁড়িতে ওঠালো। বাবার মুখ থেকে প্লুচুৎ করে এত্তখানি জল বেরোল। চোখে লাল। আর অবিশ্বাস।
*****************************************************************
আমি চামচ চামচ চিঁড়ে চালান করছি মুখে। কলার পিস গুলো পড়ে আছে। বাবা লকার থেকে একটা সবুজ প্লাস্টিকের প্যাকেট বের করেছে। চেনা প্যাকেট। ব্যাঙ্কের কাগজ থাকে ওতে। কিন্তু আজ তো রোববার!
“তকাআআই!”
শোবার ঘরে গেলাম। পা সরে না।
“আমার সব কিছু তোকে লিখে দিচ্ছি। সব সম্পত্তি। স্থাবর। অস্থাবর। সাইকেল। ঘড়ি। কলম। হাজার দুয়েক রাখছি, কাশী যাবার খরচাপাতি আছে। তবে কী, মুখে বললেই পারতিস, জলে ডুবিয়ে মারবার প্ল্যানটা কি খুব জরুরী ছিল?”