“ভগবান! রক্ষে কর ঠাকুর! যে গুরুদায়িত্ব দিয়েছ, তা বইবার শক্তি দাও ঈশ্বর।”
মনেমনে আউড়াল ফটিকরঞ্জন। ফটিকের মাথায় ভূত চেপেছিল সকালে, এখন ফটিকের সাইকেলে বউ চেপেছে। সামনে। একদিকে মুখ করে। বেয়াদব, ঠ্যাঁটা প্যাডেলটা একবার ঘুরে আসতে আসতে জগতটা একবার সূয্যিকে পাক মেরে এলো বোধহয়। বউএর মাথা ফটিকের থুতনির তলায়। মাথার চুল নাক ছুঁইছুঁই। এক দু’টো নাকের মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। নড়বড় করতে করতে এগোয় ফটিক, গোবিন্দর মা, আর ফটিকের দ্বিচক্রযানমেধের সাইকেল। এ সাইকেল ধ্বসে না পড়া অবধি পরিত্রাণ নেই। উফ! কী কুক্ষণে যে… !

“বৌঠান!” বলে ডেকেছিল ফটিক। চান থেকে বেরিয়ে গামছা পরে দরজার পাশে টাঙানো শিবঠাকুরের ক্যালেন্ডারে বার কয়েক নমো নমো করে মাথা হেলিয়ে কড়ে আঙুল দিয়ে ঝেড়ে কানের জল বের করেছিল। তারপর আদুরে গলায় বউ এর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “বৌঠান?”। গোবিন্দর মা অতিশয় বিস্মিত, সন্দেহকাতুর, জিজ্ঞাসু, ঝাঁঝসংকুল কণ্ঠে বলল, “বলি ভীমরতি ধরেচে?” ফটিক উত্তর না দিয়ে ভেজা গায়ে গোবিন্দর মা’কে জড়িয়ে ধরে সোহাগ করতে লাগল। ফটিক দুই হাতে গোবিন্দর মা”কে বেড় দিতে পারে না। দিল্লির সেই মর্চেহীন লোহার স্তম্ভের মত। বেড় দিতে পেরেছ কি যা চাইছ তাই পাবে। আপাততঃ গোবিন্দর মা রুটি বেলার বেলনা দিয়ে ফটিকে হাঁটুতে এক মোক্ষম ঘা বসিয়ে বলল, “বৌঠান ডেকে তাপ্পর সোহাগ কর্তে এসেচ?”, তারপর দু’পা পিছিয়ে দাঁড়াল। ফটিক হাঁটুতে হাত বুলোতে বুলোতে আমতা আমতা করতে লাগল। তার বিশেষ আদরের সম্বোধন জানা নেই। সোনা, বাবু, বাবুসোনা, সোনাবাবু, ডার্লিং, বেবি, বে – তার গলা বেয়ে উঠবে না। গোবিন্দ এক গাল দই চিঁড়ে নিয়ে ছুটোছুটি করবার সময় তার মা প্রথম চারটি বিশেষণে আপ্যায়ণ করে। গোবিন্দর মায়ের নাম মোনা নয়। ডার্লিং সেখেনেই খারিজ। ফটিক গতসপ্তাহে একবার ডলপুতুল বলে ডাকার চেষ্টা করেছিল। তিনবারের বার তার বউ আপিসে বেরোবার ঠিক আগে তার মুখে পাউডারের কৌটো উলটো করে দিয়েছিল। চুল, ভুরু সাদা হয়ে গেছিল ফটিকরঞ্জনের। এক দিনে এত বয়স বেড়ে গেল – নিয়ে ঠাট্টা করতে কেউ ছাড়েনি। শুধু টাইপিস্ট সুচিত্রা কিঞ্চিৎ ঘোরাঘুরি করছিল বেশি। বৌঠান ডাকটা বেশ রোমান্টিক লাগে ফটিকের। বেশ একটা “আমার হাতের পান খেতে নেই বুঝি?” মার্কা ভাব। ফটিক জিভ কাটল। অন্যায় হয়ে গেছে। নিজের বউকে… ছিছি। মহিলা চাকীটা ঢালের মত আর বেলনা টা তরবারির মত ধরে দাঁড়িয়ে আছে বাইরের ঘরে। ফটিক বুঝল আজ আপিস গিয়ে কাজ নেই। জলের গেলাসের পিছন থেকে যেন কতকটা আনমনে প্রস্তাবটা সভায় পেশ করল ফটিক। মিনমিন করে। “গোবিন্দ তবে কোথায় থাকবে?” ফটিক এক গাল হেসে বলল, “সে ওকে নামিয়ে দিয়ে আসি চল ইস্কুলে। তারপর…”

তারপর সাত সমুদ্র, তেরো নদী, আর বিশেখালির বাজার পেরিয়ে ভারসাই এর তীরে সাইকেল আর তার মালিক জিরোতে বসল। সাইকেলের কাঁধ থেকে খয়েরি বাজারের থলে ঝুলছে। ভিতরে বাজার নেই, সে’টা বলাই বাহুল্য। মালিকের বউ মালিকের ঘাড় ঘেঁষে এসে বলল, “শুনছ?”
ফটিক তাকাল। “কী?”
গোবিন্দর মা আঙুলে আঁচল পাকাতে পাকাতে বলল, “এমনি।”