কাপড়মেলা একটা হাট। ঠিক হাট না, মাঝেমধ্যে বসে হাটের মত। কিন্তু ঠিক বিকিকিনি হয়না। কাপড়মেলা তাহলে একটা জাদুঘর। সেই জাদুঘরের কিউরেটর হচ্ছে কাপড়মেলার রাণী। সংসদ বলেছে রাণি লিখতে, কিন্তু দীর্ঘঈ ছাড়া দাপটটা ঠিক আসে না। কাপড়মেলা পঞ্জিকা দেখে বসে না। রেডিওর আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস শুনে বসে। তেমন তেমন ঝলমলে দিন হলে কোন্নগরের কোথায়বাড়ির ছাদে গেলেই এই মেলা দেখতে পাওয়া যায়। এইয়া বড় গামলা কাঁখে করে রাণী উঠছেন সিঁড়ি বেয়ে। ধপধপ আওয়াজ হচ্ছে। একটু আগে কলতলায় ছপাক ছপাক করে কাপড় থোপা হয়েছে। সাবানের ফেনা উড়েছে বুদ্‌বুদের মত। চোখের পাতায়, চুলের গোছায় এখনও একটু লেগে। রাণীর হাতের চামড়া কুঁচকে গেছে এত জল ঘেঁটে। কাঁখ থেকে ধপাস করে ছাদের মেঝেতে নামিয়ে রাখা হল গামলা। ছাদের চার কোণায় চারটে বাঁশের খুঁটি। হরেকরকম নক্সায় দড়ি গেছে এস্পারওস্পার। সমান্তরাল, কাটাকুটি। রাণী হিসেব কচ্ছেন। সব রঙের পাশে সব রঙ যায় না। সব আকারের পাশে সব আকার যায় না। একটা ফর্মুলা আছে। সে ফর্মুলা আয়ত্ত না হলে রাণী হওয়া যায় না। 

মেলা বসার মাহেন্দ্রক্ষণে কিছু দর্শক জুটেছে। পাশের চারতলা বাড়িটার ছাদে একটা অ্যালুমিনির পাঁজর আছে। সে’টা বিজলি পাকড়াও করে মাটিতে চালান দেয়। তার উপর ছ’টা কাক এসে জুটেছে। বিভিন্ন কার্নিশ বা ব্যালকনি সীটে রোজকার পায়রারা। সিঁড়ির ঘর থেকে আমি। রাশিয়ান দূরবীন চোখে। নিমগাছটা হেব্বি বড় হয়েছে। বুড়ো পাতা চেবালে কচকচ করে, কচিপাতা তুলতে ছাদেই আসতে হয়। রাণী কিলিপ খুঁজে পাচ্ছেন না। আমি আমার রুশ দূরবীনের কাচ পরিষ্কার করতে গিয়ে বুঝেছি ময়লা আসলে আমার চশমায়। এই দূরবীনটা অদ্ভুত। চোখে লাগালে কানেও শোনা যায়। যার দিকে তাক করবে, তার কথাও শুনতে পাবে। যতদূরেই থাক। রাণীর ভুরুও আঙুলের ত্বকের মত কুঁচকেছে। কে সরালো কিলিপ? টুনটুনি? টুনটুনির খুব ঠোঁট্টান আছে। যা-ই দেখবে বাসায় নিয়ে যাবে। সুপুরি গাছের উপর। সেই দিকে তাক করলাম দূরবীন। টুনটুনিও মেলা দেখতে বসেছে। 

মেজদাদা উঠে এসেছে। ছাদের এক কোণে, জলের ট্যাঙ্কির ছায়ায় লকলকে হয়ে বেড়ে উঠেছে তার গাঁজাগাছ। কবে কলি হবে কবে কলি হবে… কলিকালের জন্য এত অধীর হয়ে কাউকে অপেক্ষা করতে দেখিনি। আমিও প্রসাদ পাবো। পাতা ভেজে বড়া হবে। সবাই খাবে। আমিও খাবো। মাসিমা মাছ ধরতে গেছেন। মাছ উঠছে না। একটা ঢোঁড়া সাপ এসে চার খেয়ে যাচ্ছে। মাসিমা আলগোছে, বিরক্তি ভরে সাপটার ঘেঁটি ধরে তুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। আমি অপেক্ষা করছি, একটা গায়ে শ্যাওলা নাকে নথ বৃদ্ধ পাকা বোয়ালের। বোয়াল জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাচ্ছে না। আমি চোখ সরিয়ে ছাদে নিলাম ফের। রাণী কোমরে হাত দিয়ে এক ফুঁয়ে বেয়াড়া অবাধ্য চুল সরালেন মুখের উপর থেকে। এইবারে জাদু হবে। নইলে আর কীসের জাদুঘর। 

রাণী বিড়বিড় করে সূর্য্যমন্ত্র জপ করলেন। তেজ আছে। পাতা আছে। নারকেল সুপুরির পাতার ছায়া আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছে ছাদের পিঠে। রাণীর চটি ফটরফটর করছে, কারণ ছাদের পিঠ আছে তেতে, খালি পায়ে হাঁটা অসম্ভব। পুজোয় পাড়ায় লটারি হয়। একটা গোল বাক্সে কিছু চিরকুট পোরা থাকে, হাত ঢুকিয়ে আন্দাজে একটা বের করে নিতে হয়। প্রথমেই বেরোল একটা বিছানার চাদর। মেটে রঙের। যা রঙ, তার চেয়ে গাঢ় লাগছে, ভিজে আছে বলে। হেঁইয়ো বলে রাণীমা দড়ির ওপাশে তাকে ছুঁড়ে দিলেন। কী লক্ষ্য, কী ভেদ! এ’পাশ ও’পাশ একদম সমান। কোনওদিকে এতটুকু ঝুলে নেই। গামলার মধ্যে কেমন দড়ি-পাকানো হয়ে ছিল। খুব নিংড়ানি খেয়েছে। এখন কোমরে দড়ি। টানটান করে দিলেন এমন, একটু ভাঁজ রইল না। খড়ি দিয়ে ওতে অঙ্ক কষা চলে! এরপর একটা শার্ট। শান্তিদাদার শার্ট। সাধারণ লোকে হয় হ্যাঙ্গার ব্যবহার করে, নয়ত ওই, দুপাশে হাতা ঝুলিয়ে লম্বালম্বি মেলে দেয়। একটা লোক যেন একটা পাইপের উপর শুয়ে আছে। ওতে জামাটার অস্বস্তি হয়না, বলো? রাণীমা জামাটার দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকানি দিলেন। অজস্র জলের ফোঁটা নারকেল সুপুরির ফিল্টার লাগানো রোদের রেখায় ঝলমল ঝিলমিল করে উঠল সোনালি হয়ে। যত কুঁচকানো ভাঁজটাজ ছিল, সবক’টাকে পড়ে যেতে দেখলাম। শুকোলে পরে আর ইস্তিরি করতে হবে না। দুই কাঁধের ঠিক ধারটায়, যে’খান থেকে খাদ শুরু হচ্ছে, হাতা গজাচ্ছে দু’টো, সেইখানে রাণীমা কিলিপ লাগালেন। এত শক্তিশালী দূরবীন দিয়েও ঠাহর হল না কিলিপ তিনি পেলেন কোথায়? দু’টো গুঞ্জনপাখি ঠোঁটে করে ধরে রেখেছে জামাটাকে, পাখাদু’টো হাওয়াকে বাতাস করছে। 

এমনি করে গামলা থেকে কত কী বেরোল। হাপ্প্যান্ট ফুলপ্যান্ট টেপজামা বালিশের-ওয়াড় সায়া বেলাউজ স্যান্ডোগেঞ্জি মোজা জাঙ্গিয়া পুলোভার নাইটি ওড়না পাজামা। কাচার সময় বোঝা যায়নি, শান্তির সাদা জামাটার পকেটে একটা গোল সিল্যুয়েট দেখা যাচ্ছে এখন, দুইটাকার কয়েন। কাঁধের কাছটা একটু সিঁদুরও লেগে আছে যেন। সে থাক, উনি তো আর কাপড়কাচাররাণী নন। মেলা বসেছে! মেলা বসেছে! কত রঙ! কত দর্শক! নতুন হওয়া ফ্ল্যাটটা থেকে একটা চেনা চেনা লোক চোখে কালো চশমা পরে মেলা দেখছে আর একটা খাতায় কীসব লিখছে। কবিতা? গান? একটা হলদে শাড়ি শুকোচ্ছে আর গোপালের জাঙ্গিয়াটা আকাশি? খতিয়ান নিচ্ছে, হিসেব রাখছে বুড়ো। 

কাপড় মেলা হয়ে গেছে। রাণীর আরও মেলা কাজ আছে। গাঁজাপাতার বড়া ভাজতে হবে। মায়ের তোলা মাছ রাঁধতে হবে কালোজিরে দিয়ে। খুব তেল হয়েছে মাছটার। কাকগুলো রেললাইনের উপরের তারে গিয়ে সভা করছে। টুনটুনির চোখ ঢুলুঢুলু। আমারই কোনও কাজ নেই। জলের ট্যাঙ্কির ছায়ায় একটা সিড়িঙ্গেপানা ছেলেকে দেখতে পাচ্ছি। কখন কোদ্দিয়ে উঠল? ওকে আমি চিনি। ওর নাম দুনিয়া মাদক। মোদক নয়। মাদক। দীনদুনিয়া মাদক। পৃথিবীতে দু’টো দুনিয়া। একটা আমাদের সবার, একটা ওর নিজের। মহাজ্ঞানী ছেলে। মুখ খুললেই মণিমানিক্য। ওর হাতে ঘোলের গেলাস। ছাদটা এখনও ঝলমল করছে। কাপড় থেকে টুপটুপ করে ঝরে পড়া জল দিয়ে কেমন নদী হয়েছে কতগুলো। সবক’টা গিয়ে মিশেছে বড় নদীটায়। সেইটে আবার উপুড় হয়েছে কোণার গর্তটায়। পাইপ নিচে কলতলায় চলে যাচ্ছে কাপড়মেলার জল। আমি এ’সব দেখছি। কোথা থেকে একটু ভূপালি শুনতে পাচ্ছি। একটা বলিষ্ঠ গলা, তারপর অনেকগুলো কচিকাঁচার রিপিট। কাকাতুয়া চন্দনা বুলবুলি ময়না, ভালো করে গান করো তবে দেব গয়না। 

আমি ঠায় উপুর হয়ে শুয়ে হাতের উপর থুতনি রেখে কাপড়মেলার মাঠের দিকে তাকিয়ে আছি। শুকিয়ে আসছে। শুকিয়ে আসছে সবকিছু। ছায়াগুলো পা টিপে টিপে জায়গা বদল করছে। গাঁজাপাতার বড়া খেয়ে পাড়াশুদ্ধু ঘুমিয়ে। আমাকে দেয়নি। ভেবেছিলাম দেবে। ভুল ভেবেছিলাম। মনোহরজ্যেঠা ভেবেছিল ওই ক্যাটকেটে লাল রঙটা ওদের বাড়ির বাইরের দেওয়ালে খুব মানাচ্ছে। ভুল ভেবেছিল। কয়েকটা বেপাড়ার মেঘ ঢুকছে হঠাৎ। কুকুরগুলো আকাশের দিকে তাকিয়ে চেঁচাচ্ছে। মেলা ভেঙে যাবে রে এবার, মেঘগুলোর গতিক সুবিধের না। মনাআআআআআ বিষ্টি নেমেছেএএএ … দুদ্দাড় দৌড়। খড়কুটো উড়ছে। দেরেনানা দেরেনানা করে খুব ঝালা বাজছে, তরফদারি গুলো কোঁকাচ্ছে। আমাকে এবার জানলা দিতে হবে, নইলে ঘরে ছাঁট ঢুকবে। আসি?