নাম দেওয়া ব্যাপারটা অদ্ভুত সুন্দর। আমার নিজের অসচতেনেই আমি অনেককিছুর নাম দিই। অনেকেই দেন। আমিও দিই। কিন্তু আমিও সবকিছুর নাম দিই কি? কাদের নাম দি? সেই তালিকার অন্তর্ভুক্ত হবার ক্রাইটেরিয়া কী?
আমার তিনটি হাতফেরতা গাড়ির নাম জগদ্দল, অসীমা, ও মীরাবাঈ। জগদ্দল, কারণ হদ্দপুরোনো, প্রায় লোহালক্কড় হয়ে যাওয়া গাড়ি। সে দুর্ঘটনায় দেহ রাখার পর আগমণ অসীমার। মুরাকামির কাফ্কা অন দ্য শোর বইতে এক প্রিয় চরিত্র মাজদা মিয়াটা চালাতেন। আমার গাড়ি মিয়াটা না হলেও, মাজদা। এক পিজ্জা ডেলিভারি ভাইপোর থেকে জামাইকান রামের মারফত কেনা। একটু ডাইগ্রেস করছি – জামাইকায় জন্ম, বড় হওয়া কিন্তু আমেরিকার নাগরিক আমাদের এক মেকানিক ছিল, যার নাম রাম। আমি জামাইকান রাম বলতাম। যাকগে, গল্পের সেই চরিত্রের নাম ছিল অসীমা। Osheema. সেও দেহ রাখল। প্রিয় বন্ধু শ্যামের থেকে এল তৃতীয় চারনিক ঘরণী। মীরাবাঈ। এ নাম আমার দেওয়া নয়। তবু তার রাখা মানে আমার রাখাই। তোমার নৌকা পাহাড়তলী যায়, ও মীরাবাঈ।
আমি কারুর নাম পছন্দ না হলে মনে মনে তাদের অন্য নামে ডাকি। ক্ষয়াটে দাঁত কাকু, রোজসর্দি জ্যেঠু, নিজের-চরকা-থাকতে-নজর-অন্য-চরকা-বুড়ি। বুয়েছ দাদু, টো-টো দাদু। ওই যে সুন্দর মতো মেয়েটা। মাকে কী নামে ডাকতাম বলা যাবে না। আমি হিজিবিজবিজের গল্পের নামকর (যে নামকরণ করে, তাকে কি নামকর বলে?) নই, কিন্তু তবু নাম দিতে ভালোবাসি। প্রিয় জিনিস মাত্র নাম দিই। খুব জ্বালালেও দিই। যার ইতিবাচক বা নেতিবাচক, কোনওরকম গুরুত্ব আছে, তারই নাম দিই। আমার মনে হয় সব মানুষের নামকরণের এই ক্রাইটেরিয়া এক। সবাই না চাইতেই তাদের কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, নিত্যের অংশ হয়ে ওঠে, সে’সবের নাম দিয়ে ফেলে। বাথরুমে কমোডের উলটো দিকের দেওয়ালে ছাদের সঙ্গের কোণটায় জাল-বাসা পেতে বসা মাকড়সাটার নাম দেয় নেত্রলোচন। মাকড়সার সত্যিই অনেকগুলো চোখ, তাই তার নাম চোখ-চোখ রাখলে তাতে কোনও দোষ হয় না।
কিছুতে নাম দিয়ে ফেললেই যেন ডাকবার একটা দায় এসে যায়। যার সঙ্গে ওই একবারই দেখা হবে, তাকে নাম দেওয়ার খাটনি আমরা করি না। হয় নিজের হলে নাম দিই, নয়ত রোজ মোলাকাত হয় বলে। তাই নাম দিয়ে দিলেই যেন বুঝিয়ে দেওয়া হয়, শোনো, আগামী অনির্দিষ্টকাল অবধি তোমার অস্তিত্ব আমার খুব ধারেকাছে আছে। আমি তোমায় দেখছি। তুমি আছ। আমার জীবনে। তুমি নাম দেওয়ার মতই গুরুত্বপূর্ণ।
এই “কাছের” পরিধিটা সবার আলাদা। সবারই কিছু কিছু একান্ত আপন থাকে। অজান্তেই জড়কে প্রাণীত্ব অরোপ করি। জগদ্দল একটা বুড়ো লোক। টেকো, সাদা দাড়ি। কর্মঠ। সেই গ্রামের বুড়োদের কথা শুনি না? সত্তর বছর বয়সেও কাঠ বয়ে নিয়ে ফিরছে জঙ্গল থেকে। ও’রম। অসীমা একটু বালিকামতো তরুণী গোছের, নামটা প্রাচীন হলেও। আমার সঙ্গে ঠিক অমনই সম্পর্ক। প্রেমের নয়, কিন্তু মেয়েটা কলরবলর করে, ভাল্লাগে। মীরাবাঈ একটু বেশি বয়সের ভালোবাসা। বেশি বয়স বলেই উদ্দামতা একটু কম, কিন্তু যখন হয়… মীরাবাঈ একটু রাজলক্ষ্মীর মতো। আংশিক গভীর উইথ এ সম্ভাবনা অফ বজ্রবৃষ্টিসহচপলতা।
নাম ধরে ডেকো। নাম ধরে ডাকাটা ভালো জিনিস। আমরা সম্পর্ক ধরে ডাকি বড়দের। তাই তাঁরা দূরে থাকেন। বন্ধুদের নাম ধরে ডাকি, তাই তারা কাছের। আমার নাম ধরে ডেকো।