অরণ্যদেব বুঝতে পারেনি সে ধরা পড়ে যাবে। তবে তার বোঝা উচিৎ ছিল। পৌনে দশটার সময় গেরস্তবাড়িতে খবরের কাগজ দিতে এলে ধরা পড়বারই কথা। এমনিতে সে চলমান অশরীরী। কেউ জানেনা সে কখন কাগজ দিয়ে যায়। শুধু হঠাৎ করে দেখতে পাওয়া যায় বাইরের দরজার সমান্তরাল ছিটকিনিতে আটকানো আছে দৈনিক টরেটক্কা, বা বারান্দার লোহার গ্রিলের ফাঁকে গোঁজা মশলাবাজার পত্রিকা। ভোরবেলা থেকে তার অপেক্ষায় জেগে থেকেও লাভ হয়নি। ঘ্যানঘেনে ঝিমুনির মধ্যে কাগজের খচরমচর শব্দ শুনে আঁতকে উঠে দেখেছি কাগজ আছে, ওলা নেই। মাসের আঠাশ তারিখ করে কাগজের ভিতর গোলাপি স্লিপে বিল বোঝানো থাকে। “জিলিপিবাজার পাঁচটাকা। আঠাশ দিন। একুনে একশত চল্লিশ টাকা। শনিবার করে ক্রোনোলজি অফ ইন্ডিয়া বাবদ সাড়েসাতটাকা। এ মাসে ছিল চারটে শনিবার, অর্থাৎ তিরিশ টাকা। মাসিক সারিতারা তিরিশ। মোট দুইশতটাকা।” পাঠক ভাবছেন, টাকাটা দেবার সময় তো অন্ততঃ তার দেখা মেলে? দেখা মেলে না, মেলে না, আজ ফিরে এসে নিজের দেশে… না। স্লিপের ও’পিঠে পরিষ্কার বাংলায় নির্দেশাবলী থাকে। “আগামী মাসের তিন তারিখের ভিতর দুইটি একশো টাকার নোট বা একটি দুইশো টাকার নোট খয়েরি খামে আপনাদের ডাকবাক্সে রেখে আসবেন, আমি নিয়ে নেবো।” যে’টা লেখা থাকে না প্রচ্ছন্ন ভাবে, অথচ ভাষার ভাবে স্পষ্ট অনুধাবন করা যায়, তা হল, “পুলিশে খবর দিবেন না। দিলে আপনাদের কাগজ অক্ষত থাকিবে না। খেলার পাতা ছিঁড়িয়া লইব। শব্দজব্দের উপরনীচের ১৯ নম্বর সূত্র কাটিয়া দিব। ভারতাধিনায়কের চোখে জলদস্যুসুলভ এক চোখো চশমা ও গোঁফ আঁকিয়া দিব। প্রত্যহ সুস্থ অবিকৃত সংবাদপত্র চাহেন তো পুলিশে খবরদার খবর দিবেন না।”
এ হেন চলমান অশরীরী ধরা পড়ে গেল। গতকাল মাঝরাত থেকে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কংক্রিট থেকে গাছ উঠবার উপক্রম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নিলে শ্বাসনালীতে জল ঢুকে যাচ্ছে। সাড়ে তিনটে নাগাদ এমন বাজ পড়ল, পাঁচিলের উপর থেকে বাদামি বেড়ালটা চমকে উঠে পাকা আতার মত খসে পড়ে গেল। সেই থেকে কারেন্ট নেই। নেই তো নেই। প্লাস্টিকের বালতিতে একটু কারেন্ট মজুত করা ছিল, তাই দিয়ে ভোরটুকু অবধি চলল। তারপর থেকে প্রস্তরযুগেই রয়েছি। সামনের গলিটা দিব্যি স্রোতস্বিনী তরঙ্গিনী হয়ে উঠেছে। একটা লাল চটি ভেসে ভেসে যাচ্ছে পাল তুলে। বৃষ্টির শব্দের ধরণ পাল্টে গেছে। আগে সিমেন্টের গলিতে চ্যাটচ্যাট করে পড়ছিল। এখন আধভরা বালতিতে কলের জল পড়ার মত আওয়াজ হচ্ছে। আমরা দাড়ি চুলকাচ্ছি। যাদের দাড়ি নেই তারা মখমলি গাল চুলকাচ্ছে। সময়জ্ঞান লুপ্ত হয়েছে। আকাশ দেখলে মনে হবে সকাল সোয়া ন’টাও হতে পারে, বেলা দেড়টা হলেও কারো বলবার কিছু নেই, পাঁচটা বাজলেই বা আটকাচ্ছে কে? তবে মনে হচ্ছে যেন গভীর রাত হয়ত না। মানে, হতেই পারত, কিন্তু মনে হচ্ছে নয়। বড়রাস্তায় গাড়ি নেই ঘোড়া নেই কুকুর নেই অটো নেই সবজিওলার ঠেলাগাড়ি নেই। বাড়িগুলোতেও আদৌ মানুষ আছে বলে ঠাহর হয় না। কিন্তু আমাদের বাড়িতে আমরা আছি। তাই ধরে নিচ্ছি অন্যেরাও স্ব স্ব বাড়িতে আছে। বেশ একটা আটলান্টিস আটলান্টিস ভাব জাগছে। সাগরতলার গুপ্ত শহর। মানিকের গোলার পাশের সুপুরিগাছটায় একটা মাঝারি আয়তনের হাঙর এসে বসল। মোড়ের মাথায় দু’টো জেলিফিশ তারস্বরে ঝগড়া করছে। আমার এক বন্ধুকে একবার জেলিফিশে কামড়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে সে প্রত্যেক রেস্টুরেন্টে খুঁজত, তারা জেলিফিশ রান্না করে কিনা। তারপর পমফ্রেট মাছে ম্যাঙ্গোজেলি লাগিয়ে খাওয়ানোয় খানিক শান্তি পেয়েছিল।
ঘড়ি অনুযায়ী পৌনে দশটার সময়, আসলে হয়ত ভোর ছ’টা, একটা ডুবুরি পোশাক পরা লোক, অন্তত দূর থেকে তাই মনে হল, সাইকেলে করে আমাদের গলিতে ঢুকল। আমি গ্রিলের মধ্যে দিয়ে মাথা গলিয়ে বোঝবার চেষ্টা করলাম তার পায়ে ব্যাঙের পায়ের মত সেই ডুবুরি-স্পেশাল পা লাগানো আছে কিনা। সেই গাঢ় খয়েরি ডুবুরিপোশাক অথবা রেনজ্যাকেট পরা ছায়ামূর্তি আমাদের গেটের বাইরেই তার সাইকেল থামাল। তার বাজারের ব্যাগ থেকে সাদা প্লাস্টিকে মোড়া জেলিফিশবাজার বের করল। ঠিক তখনই ঘটল একটা অভূতপূর্ব ঘটনা। অরণ্যদেব ভেবেছিল কেউ কোত্থাও নেই। ধুধু পরিত্যক্ত নগরী। অথবা সেও ভেবেছিল ভোর চারটে বেজে বাইশ মিনিট, এখনও সবাই ঘুমুচ্ছে। সব জানলার পাল্লা খুলে গেল,পর্দা উঠে গেল। সারিসারি মাথা ওঁৎ পেতে ছিল। খপ করে ধরল। চারদিক থেকে একটা “খবর খবর খবর চাই খবর দাও” হাহাকার উঠল। অরণ্যদেব ধরা পড়ে মাথার উপর থেকে রেনকোটের হুড সরাল। একটা ছোটখাটো সদ্য গোঁফ গজানো ছেলে। চশমার কাচে জলের ছিটে। জলের তলায় মেঘনাদ হয় না। কিন্তু প্রায় সে’রকম ই একটা কিছু শোনা গেল, অদৃশ্য বক্তাদের থেকে।
“পল্টু। তোমার কাজ খবর দেওয়া। তুমি বার্তাবহ। তুমি দূত। তুমি সংবাদ-আনক। তুমি -“
“মন্টুবাবু আপনি চুপ করুন তো! সংবাদ-আনক বলে কোনও কথা হয় না। বড়জোর সাংবাদিক বলতে পারেন। অ্যাই পল্টু, বলছি যে -“
“স্যরি কাকু। আসলে এত জল জমেছে! ম্যাটাডোর গুলোই দেরী করেছে, মাকালীরদিব্যি আমি-“
“আহ! লেট করেছিস বেশ করেছিস। শোন না। যে খবর চাইছি, দে।”
“কাগজ তো দিলাম কাকু।”
“আহ সে খবর নয়। আমরা তো বেরোতে পারিনি। তুই বেরিয়েছিস। হ্যাঁরে পল্টে, বাজার বসেচে?”
“না কাকু হাঁটুর উপরে জল তো”
“পল্টু সোনা, সাহার দোকান খুলেছে রে? এক প্যাকেট বিড়ি এনে দিবি? তেষ্টায় গলাটা…”
“বলছি কাত্তিক গাঙ্গুলির সিঁড়ির ঘরে জল ঢুকেছে রে? দেখলি কিছু? দরজার মুখটা উঁচু করিয়ে হেব্বি ঘ্যাম নিচ্ছিল লোকটা। এইবার মজা টের পাবে। দেখলি? দেখতে পেলি?”
সমুদ্র-উদরের গুপ্ত সাম্রাজ্যে একজন ডুবুরি এসে ডাঙার হাল-হকিকত দিতে থাকে। শুধু বৃষ্টি কবে থামবে, সে খবর কেউ জানেনা।