পরমপ্রিয়েষু বতুতা,
সহস্র বৃষ্টি আসিয়া চলিয়া গিয়াছে। তাহারা এখনও আসিতেছে, কিয়ৎক্ষণ থাকিয়া ফিরিয়া যাইতেছে। নিরন্তর তাহাদের এই আগমণ, প্রস্থান। তাহাদের আবির্ভাবের কোনও তিথি নাই, তাহারা মেঘের উপস্থিতির উপর নির্ভরও করে না আজকাল। আষাঢ়ের শুরুর দিকে তাহারা কিঞ্চিৎ বাধ্য ছিল। মেঘের সহিত আসিত। মেঘ অদৃশ্য হবার বহু পূর্বেই তাহারা মিলাইয়া যেত। এখন উহারা পথ চিনিয়া গিয়াছে বোধ হইতেছে। খটখটে রৌদ্রজ্জ্বল দিনেও উহারা আসে। রাজপথ আর্দ্র হইবামাত্র শুষ্ক হইয়া যায়। তাহাদের উপদ্রবে আমি আজ অবধি একবিংশটি ছত্র হারাইয়াছি। হারাইয়া, আপাদমস্তক ভিজিয়া আসিয়া মোমবাতির আলোকে সে হারানোর কথা লিখিতেছি এই ছত্রে। তোমাকে হারাইবার কাহিনী কি তবে ছত্রদের কাছে কহিব?
তোমার হস্তাক্ষর মুক্তার ন্যায়, তথাপি তোমার পত্র প্রাচীন শিলালিপির মতোই দুর্বোধ্য। খুব হঠাৎ হঠাৎ তোমাকে অপরিচিত বলিয়া মনে হয়। তুমি কী ভাবিয়া কী লিখিয়াছ, তাহা ভাবিয়া আমি কূল পাই না। এই মনে হইতেছে একুশ পালের তরী ছুটিতেছে ঘাটের নিমিত্ত, কেবল ভেড়বার অপেক্ষা, অমনি কোথাও কিছু নাই, দেখি মাঝগাঙে হাবু এবং ডুবু খাইতেছি। ইবন, আমি তোমাকে কদাচ মৃত সরলরেখা দিই নাই। মৃত কি জীবিত, সরল কি বক্র, কোনোরূপ রেখাই দিই নাই। তোমায় স্পষ্ট হইতে বলিতেও আশঙ্কা হয়, যদি তাহা সহ্য না করিতে পারি? তাহার চেয়ে যাহা চলিতেছে চলুক, আমি শম্বুকের খোলস হইতে মুখ বাহির করিয়া ক্ষণে ক্ষণে চাহিব।
নির্বাসনের মেয়াদ শেষ হওয়া যে আরেকরকম নির্বাসন, কে জানত! ইলতুৎমিশের মনে হয়, জানত অনেকেই, কেউ স্বীকার করেনি কখনও। টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছে, “এই নির্বাসন শেষ হওয়ায় আমি খুবই আনন্দিত। আমার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করবার জন্য আমি খুবই আগ্রহী।” বাড়িতে, বন্ধুদের বলেছে, “ঊফ, বাঁচা গেল! বিতিকিচ্ছিরি অপয়া জায়গা।” কখনও কি কমোডের উপর বসে আচ্ছন্ন হয়েও নিজেকে বলেনি, “ধুস! দিব্যি ছিলাম।” তারপর সচেতন হয়ে গন্ধ তাড়াবার মত করে হাত নাড়িয়ে স্বগোতোক্তি তাড়িয়ে ফ্লাশ টেনেছে। ইলতুৎমিশের এই রাখঢাকের বালাই নেই। বাইরে গোরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বাক্স প্যাঁটরা লোটা কম্বল নামছে একে একে। যা আছে, যৎসামান্য। মীরাবাঈ, ঘুড়ি মীরাবাঈ গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ঘাস চিবোচ্ছে। লাটাই সুলেইমানের হাতে। তার রাজপ্রাসাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে জলের ট্যাঙ্কির দিকে মুখ করে তারস্বরে চিল্লিয়ে ইলতুৎমিশ বলছে, “পাইনহাটা একটা ফালতু জায়গা। পোড়ামুখো জায়গা। হুতোমপাছা জায়গা। কানের গোড়া জায়গা। এখান থেকে যাবো না, যাবো না, যাবো না।”
“যাবো না যাবো না যাবো না”। একটা একরত্তি নেংটিপরা ছেলের নাইবার সময় হয়ে এসেছে। সে বাগানে খেলছে। খেলছে, যত “আয় বাবু আয় সোনা আসবি কিনা না এলে কিন্তু” উপেক্ষা করে। খেলছে প্রত্নতাত্ত্বিক হবার খেলা। তার নাম রেখেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা, সে-ও কিছু ফিরিয়ে দিতে চায়। দৈবাৎ একটা মমি কি একটা ডাইনোসর বেরোলে তার নাম সে নিজের নামে রাখবে। আপাততঃ সে খুরপি দিয়ে খুঁড়ছে। মাটিপোকারা ভিটেছাড়া হচ্ছে। শীত ফুরিয়ে আসছে পানিহাটিতে। রাজবাড়ির সামনের উঠোনে অ্যালুমিনিয়ামের বালতিতে জল গরম করতে রাখা। স্নানের জল। শীতের সূর্যের তেজ তার ধার মেরে ফেলে বড় মোলায়েম করে দেয়। তুঘলক বলতেন “কাল কাটানো।” একটা হুমদো লোক বাচ্চাটাকে এক ঠ্যাঙ ধরে শূন্যে তুলল। “এক্ষুণি চল তুতান। জল জুড়িয়ে গেলে তোর মা তোকেও আস্ত রাখবে না, আমাকেও না।” তুতানখামেন অনায়াস দক্ষতায় তার বাবার শরীর বেয়ে মাথা নিচে ঠ্যাং উপরে থেকে সোজা হয়ে ঘাড়ে উঠল। তারপর বলল, “বাবা দ্যাখো! ওই গাছটায় পাতা এসেছে!”
বিচ্ছিরিবরেষু ইলতুৎমিশ,
খুব বাজে তুই। খুব। প্রথমতঃ হাজারবার বারণ করেছি সাধুভাষায় চিঠি লিখতে। প্রেমপত্র পড়ছি, না মাধ্যমিকের খাতা দেখছি বুঝতে পারি না। তাছাড়া প্রেমের তো নামগন্ধ নেই তোর পত্রে, এক সম্ভাষণ ছাড়া। তুই আঠ্যাংমাথারচুল গর্দভ, তাই আমার চিঠি বুঝতে পারিস না। ইলতু। আর চিঠি লিখব না তোকে যা। ইলতু। আর যেন আমাদের চিঠি লিখতে না হয়।
“তোমরা যাও, আসছি।” রাজপ্রাসাদে অনেক গুপ্তকক্ষ থাকে। আসলে গুপ্তকক্ষ থাকাই হল কোনও বাড়িকে রাজপ্রাসাদ বলার প্রথম শর্ত। নইলে তো অট্টালিকা বললেই মিটে যেত। সভাধ্যক্ষরা গোরুর গাড়ি ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। বলদটা কালো। গাড়িটা গোরুর, টানে বলদ। এখন জাবনা কাটছে। ইলতুৎমিশ জানালা থেকে এ’সব দেখল। তারপর গোপন কুঠুরী থেকে গুপ্তধন বের করে নিয়ে এলো। এখানে এ’সব রেখে যাওয়া ঠিক না। কার হাতে পড়বে। খোয়া যাবে। নিয়ে যাওয়াও মুশকিল। কার চোখে পড়বে। হয়ে যাবে। মুখ খোলা খামগুলোর উপর হাত বোলাতে লাগল ইলতুৎমিশ। আর একবার যদি পড়ে দেখবার মতো সময় থাকত। কোথায় লুকোনো যায়? ছেলেবেলায় মেহেরুন্নিসার ড্রেসিংটেবিলের তলায় গুপ্ত দেরাজে খামের মুখ খোলা তুঘলকের লেখা চিঠি পেয়েছিল ইলতুৎমিশ। হেব্বি মার খেয়েছিল। তার দীর্ঘশ্বাসে বাতাসে তরঙ্গ উঠল। সে পা টিপে টিপে নেমে এলো রাজউদ্যানে। এসেই ধরা পড়ে গেল। “ফেলে দিচ্ছিস তো? দে। ফেলে দে। রেখে কী হবে? চলেই তো যাচ্ছিস। এখন আর এগুলোর কী দাম? ফেলে দে।” ইবন বতুতার সামনে ঘাড় হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল ইলতুৎমিশ। নীরব। “ফেলিস না।” “ফেলতাম না! আরে! ফেলব কেন? গুপ্তধন তো! গুপ্তধন কেউ ফ্যালে? ফ্যালে না। পুঁতে রাখে বাগানে। বা খোঁজে জগৎ তোলপাড় করে। নয়ত যক্ষ হয়ে পাহারা দেয়। তারপর মেঘদূতের হাতে পাঠায়।” ইবনের মুখে হাসি ফোটে। “আমিও এনেছি। তোর পাঠানো গুলো।”
বাবা ছেলে বাগানের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটার দিকে হেঁটে যায়। অনাদিবৃক্ষ। এতদিন তার পাতা ধরতে দেখেনি কেউ। এক প্রজন্ম অন্তর পাতা হয়। এবার শেষ শীতে, বসন্ত শুরু হবার একটু আগে পত্রধর হয়েছে সে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে বরফ পড়েছে একটু আগে, জমে রয়েছে পাতার উপর। ছুটে কাছে আসে তারা। না। বরফ না। পাতাগুলোই সাদা। “আরেকটু কাছে চলো না! চলো না বাবা!” ভয়ে বিস্ময়ে পায়ে পায়ে এগোয় ইলতুৎমিশ। একটা গাছের সাদা পাতা হয় কখনও? “সাদা তো নয়। কতকিছু লেখা আছে পাতাগুলোয়। দ্যাখ!” মাটি মাখা হাতে, খালি পায়ে বাপ ছেলের সঙ্গে এসে দাঁড়ায় ইবন।
“ছিঁড়বিনা বলে দিলাম।”
“না ছিঁড়লে পড়ব কী করে?” অনুযোগ করে তুতানখামেন।
“যখন বড় হবি, তখন হাত পাবি।”