পালকির দলটা পাঙ্খাবাড়ির সদর রাস্তা ধরে দক্ষিণে চলছে। পাইকদের গালপাট্টা মিশেছে গোঁফে গিয়ে। বরকন্দাজরা ঘনঘন ঘড়ি দেখছে। বেহারাগুলো একটু বুড়ো। অল্প গোবেচারা। পালকি চলেছে অনন্তকাল। পালকি চলেছে অনন্ত পথ। পালকির ভূত পালকিতেই সওয়ার হয়ে চলেছে। সেই ভূতের নাম দেওয়া হয়েছে পিছুটান। পালকির ভবিষ্যৎ এখনও লেখা হয়নি। অন্ততঃ ধরে নেওয়া হচ্ছে যে লেখা হয়নি। হয়ে থাকলেও সে এমন ভাষায়, কারও পড়ার সাধ্যি নেই। রাস্তার দু’ধারে বর্তমানের জঙ্গল। বুড়ো বেহারা বলছে, ন’জন মিলে বাহু প্রসারিত করে ঘিরে দাঁড়ালে তবে এ-গাছের বেড় হয়। গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে মুড়ো দেখতে চাইলে ঘাড় মাটির সমান্তরাল হয়ে যাবে। গাছটার গায়ে থোকা থোকা শুঁয়োপোকা ফুটে আছে। অতিবৃদ্ধ শ্যাওলার জমিয়ে রাখা আর্দ্রতায় গা ভিজিয়ে নিচ্ছে। এই গাছটার কথা এত করে বলবার কারণ পালকির দল এর তলায় বিশ্রাম নিতে থেমেছে। পালকির সওয়ার একটিবার পর্দা ফাঁক করে বাইরে চাইল। বর্তমান এক অসূর্যম্পশ্যা অরণ্য। সে অরণ্যের গাছেরা কথা বলতে পারে। কিন্তু বলে না। এ গল্প আমার শোনা গল্প। বানিয়ে বলছি না। বানানো হয়ে থাকলে অন্যের বানানো। তার কৃতিত্ব নিচ্ছি না। গাছেরা কথা কইতে পারে, কয় না। মায়ার আড়মোড়া তাঁদের জড়িয়ে রেখেছে। সেই কঠিন আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলে আড়াই বছর ভণিতা করে তবে আসল কথায় প্রবেশ করতে হয়। তেমন আসলরকম কথা, তেমন গুরুত্বপূর্ণ কথা, তেমন বলবার মত কথা না থাকলে তারা জাগবে কেন? গাছেরা মানুষ নয়। কথা বলতে না পেলে তাদের হাঁফ ধরে যায় না। এক খেজুর গাছ ছাড়া। সওয়ারীর তাই অরণ্য এত প্রিয়। কিন্তু বর্তমান?
পালকির ভিতর মশা ঢুকেছে। এক ঝাঁক। গৃহস্থবাড়ির প্যানপেনে, পোষ মানা, অনুমতি চেয়ে হুল ফোটানো মশা নয়। বুনো, তেজিয়ান মশা। ইবন ভাবে, এরা জঙ্গলে কার রক্ত খায় তবে? ভাবে, আর চুলকোয়। হাতে পায়ে লাল গোটা বেরোয়। এই প্রাগৈতিহাসিক রক্তচোষাদের আক্রমণও ইবনের কুয়াশা ভেদ করতে পারছে না। কুয়াশাটা ভালো লাগছে। কিছুই স্পষ্ট হচ্ছে না। যতক্ষণ না হচ্ছে, ততক্ষণ পরিষ্কারটা কেমন তা জানা যাচ্ছে না, পরিষ্কারটা কতটা কাম্য, ইবন বতুতা জানে না। তাই আপাততঃ থাক কুয়াশা। কাটা অবধি ধরে নেওয়া যাক, সব ভালো। পাইকদের অবয়ব দেখা যাচ্ছে শুধু। বরকন্দাজদের বর্শা ফলা। হেড-বাহারার জর্দার গন্ধ। চারদিকের ঔজ্জ্বল্য নিম্নগামী। বর্ণ ম্লান। কী সুন্দর। সবুজটা কেমন গাঢ়। ঝিকিমিকি নেই। ঝিকিমিকি অসহ্য লাগত। মশার থেকেও। এই ভালো। জঙ্গলের গন্ধ বুক ভরে টেনে নিচ্ছে সে, মনে হচ্ছে শ্বাসনালীর ভিতরের দেওয়ালে শ্যাওলা বসে যাচ্ছে। তা যাক। রাস্তা খাদের পাশ দিয়ে এসেছে। আবার খাদের পাশ দিয়ে যাবে। কুয়াশা থাকলে খাদের ওপারের পাহাড় দেখা যায় না। কিছুই দেখা যায় না। বড় মায়া লাগে, বড় তার উদ্বেগ। খুব মনে হয় কুয়াশা ভেদ করে একটা অতিকায় পাখি অ্যাত্ত বড় ডানা ঝাপটিয়ে এসে তাকে তুলে নিয়ে যাবে আরও কুয়াশার মধ্যে। যেত। ভালোই হত। কুয়াশাদের বাড়ি কোথায়? কোন একটা পাহাড়ের গায়ে একটা গুহায় তারা থাকে। সময় হলে চরতে বেরোয়। পাহাড়ে চড়তে বেরোয়। বেহারারা তোড়জোড় করছে ফের শুরু করবার। একটা পাইক মজা করে আলতো সড়কির খোঁচা মারল এক বেহারার বুকে। ইবনের বুক চিনচিন করে উঠল। তার ধমক খেয়ে পাইকের মাথা হেঁট হল। কোমরে গামছা, মাথায় পাগড়ি বাঁধা চলছে। ইবন শুধোল, “কে গাইছ গান?” চোদ্দটা ছায়ামূর্তি একে অপরের দিকে চাইল। সুরটা তারাও শুনেছে। শুনছে অনেকক্ষণ ধরে। কিন্তু প্রশ্নটা মাথায় আসেনি, ধরেই নিয়েছে ওদের মধ্যেই ছিটিয়ে থাকা কেউ… “কই, বললে না তো? কে গাইছে গান?” সুরটা বড় চেনা। গানটা সে গুনগুন করতে পারছে। সুরটা। শব্দগুলো মনে আসছে না। অস্বস্তি হচ্ছে।
পাঙ্খাবাড়ির সড়ক ঢালু হচ্ছে এবার। পালকির গতি বাড়ছে। বরকন্দাজেরা আধা সজাগ। সুরের উৎস তারা খুঁজে পায়নি। কিন্তু লাল-গেরুয়ায় মোড়া মাথা কামানো তিনচারজন ভিক্ষু গেছে এই পথ দিয়ে, চড়াইএর দিকে। তাদেরই কেউ কি? কে জানে। চার জন বেহারা, সাতটি পাইক, আর তিনজন বরকন্দাজ মিলে ইবন আর তার ভূতকে নিয়ে চলেছে ভবিষ্যতে। চলেছে ইবনের আদেশে। চলেছে ইবনের বলে দেওয়া গন্তব্যে। কিন্তু বতুতার ভূতের থেকে মানুষটার নিজের বিচ্ছিন্ন হবার ইতিহাস বা ঘটনাক্রম তাদের অজ্ঞাত। এই দু’জনকে আলাদা করে দেখবার দিব্যদৃষ্টি এদের এখনও হয়নি। একটা ঘন নিরবিচ্ছিন্ন কুয়াশা সব কিছু আড়াল করে রেখেছে। রেখেছে ইবনকেও। এই কুয়াশার নাম ‘পরে ভাবব’। সবকিছু অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য বর্তমানে স্থগিত থাকলে ভালো হত, কিন্তু তা হয় না। পাঙ্খাবাড়ির রাস্তার ঢাল বেয়ে, পাহাড়ের পাক বেয়ে গড়গড় করে সব ভবিষ্যতের দিকে গড়াতে থাকে। সুরের ভিতরের শব্দগুলো অশ্রুত থেকে যায়। স্মরণে আসে না। যে’দিন আসবে, যখন আসবে, গানের পঙক্তি গেয়ে উঠবে ইবন, আর কুয়াশা ভেদ করে এক পাহাড় সমান ডাকাত বেরিয়ে আসবে রাস্তায়। ইয়াম্মোটা গোঁফ, চশমা নদীতে পড়ে গেছে বলে চোখ কুঁচকানো। সে চোখে কাজল। চুল ঝাঁকড়া। বরকন্দাজরা দরদাম করবে। কী চাই তোমার? হ্যাঁ? স্বর্ণমুদ্রা? চিঁড়েভাজা? ঘুম? বলো? কী চাই? নির্বাক ডাকাত পালকির দিকে তর্জনী তুলে ধরবে। আর যাবে কোথায়? দমাদ্দম লাঠি সড়কি বল্লম বর্শা। তখন কুয়াশার মশারি থেকে, সাজানো পালকি থেকে ইবন বতুতা বেরিয়ে এসে বলবে না? – “অ্যাই! তোমরা আমার ডাকাতকে মারছ কেন?”
ক্রমশঃ ফিকে হতে থাকা সাদা কুয়াশার ভিতর চারজন বেহারা, সাতজন পাইক, একটি ডাকাত, আর একজন রাজকন্যা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।
তারপর কী হবে, ভগাই জানে।