বাড়ি কী করে ফিরতে হয়? ইলতুৎমিশের অনেকগুলো বাড়ি। ইলতুৎমিশের একটাও বাড়ি নেই।

এক রাজ্য ভূতের মধ্যে, জিনের মধ্যে ইলতুৎমিশ একা বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ভূতগুলো কথা বলছে। তাদের বোতলবন্দী করতে হবে। তাদের ফিসফিসানি ক্রমে হাহাকার রূপ নিচ্ছে। ছোটবেলার গল্প শুরু হত “একদা এক…” দিয়ে। এই গল্পগুলো শুরু হচ্ছে “মনে পড়ে?” “মনে পড়ে ইলতু?”। এতকিছু একসঙ্গে মনে পড়লে চাপ। ইলতুৎমিশ তাই অবশ বিহ্বল হয়ে বসে আছে। গুপীর জুতো। যা পরে হাতে তালি মেরে কলোরাডো যাওয়া যায়। ওখানে কী বরফ, জানো মা? একরাশ পাওয়ার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে ইলতুৎমিশ। এই সবই তো পাওয়া। সব। সিন্ধুঘোটকের দেওয়া সাদা কালো ভালোবাসা। একতাড়া চিঠি। কথা আছে। চিঠির ভিতর, বাইরেও। “একদিন যখন আর চিঠি লিখতে হবে না, দু’জনে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে একটা একটা করে পড়ব। আমি তোরটা, তুই আমারটা। তারিখ মিলিয়ে।” সে তারিখ কবে আসবে? সুসময়ের গায়ে শ্যাওলা জমেছে। পিছলে যাচ্ছে কেবল। আর একটা কুটিল হাসি নিয়ে ডাকছে। “এইত্তো আমি। এইত্তো। আর একটু! এসো?!” সুসময় নিশির মতো ডাকে।

বাড়ি কী করে ফিরতে হয়? ঘুমের মধ্যে এ প্রশ্ন ইলতুৎমিশকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে ফেলবে “যে যেখানেই থাকো, অ্যাটলান্টার গোলকধাঁধার মধ্যে ইন্টারস্টেট পঁচাশি খুঁজে বের কোরো। যেও দক্ষিণে।” এগারোদিনের সজ্ঞাতবাস স্বেচ্ছা-নির্বাসনের পরে আই এইট্টি ফাইভ সাউথে নৌকা এসে পড়লে মনে হয় এইত্তো। চেনা পাড়া। চেনা গলি। এইত্তো বাড়ি। কেন? কেন কেন কেন? তোমার না ঘেন্না করার কথা? এই না এতদিন খিস্তি দিয়েছ? এই চারটে দেওয়াল ইলতুৎমিশের বাড়ি নয়। বাড়ি জুঁই। বাড়ি সমীর। বাড়ি রাইলি। বাড়ি নীচের তলার মেয়েটির শীৎকার। বাড়ি বাইরের ঘরের নীল চাদর মোড়া তোষকে বসে তৈরী হওয়া কত্তগুলো গান। মায়া এমনই, খুব সচেতন থেকেও তাকে ঠেকানো যায় না। তাই জন্যই সে মায়া। এই দিনটার কথা ভেবেই ইলতুৎমিশ কোনও আসবাব কেনেনি কখনও। এখন কুমীরের চামড়ার সাত পুরোনো ফালতু একটা গিটার-কেস আর না মেজে মেজে কফির দাগ পড়ে যাওয়া একটা কাপ আর একটা ঋতুর উর্ধ্বে উঠে সারারাত গায়ে লেপ্টে থাকা চাদরকেও আসবাব মনে হচ্ছে। আর মীরাবাঈ? মনে হচ্ছে মরে যাবার আগে উইল করে যাচ্ছে সে। বাঁশি, বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাবো কাহার হাতে?

আর যে’খানে যাচ্ছ? সে’টা বাড়ি নয় বুঝি? বাসি চানাচুরের তেল টেনে নেওয়া খবরের কাগজের ঠোঙা বলে ওঠে, হ্যাঁ, বাড়িই তো। বোর্ডিং পাস দাঁত কেলিয়ে হাসে। খবর এসেছে, বাড়ির সামনের দেওয়ালটা পড়ে গেছে। তবু উলটো দিকের মানিকদের ইঁটভাটার পাঁচিলটা সিমেন্টের বিজ্ঞাপনের আর ভোটের লিখনের রঙ মেখে তরতাজা। সেই গলিতে এখন ব্যাডমিন্টন খেলা চলছে। কলতলার টিউকলটা জীবাশ্মের মত দাঁড়িয়ে আছে, ডাকবাক্সের মতো দাঁড়িয়ে আছে। হাতল চাপলেই চিঠি বেরোবে। কী করে ফেরে, বাড়ি? চিনতে পারবে, ইলতুৎমিশ? ভয় হচ্ছে না তো? বেন্ট ক্রিক, গ্লেন অ্যাভিন্যুর মতোই সড়গড় এখনও তো বন্দিপুর রোড, মিস্তিরিপাড়া? মসজিদের দেওয়ালের কালো বোর্ডে নমাজের সময় লেখা, পড়তে পারবে তো? পানাপুকুরগুলো বুজিয়ে কোন রঙের ফ্ল্যাট উঠেছে, জানো না কিন্তু। মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যাবলা হাসবে না তো? রাতে উঠে বাথরুমে যাবার পথে কিছুতে হোঁচট খাবে না? অটোর সামনে বসতে পারবে? গলিগুলো বেশি সরু মনে হবে না? তোমার বাড়ি তোমাকে মনে রেখেছে, ইলতুৎমিশ? এই যে গতকাল ঘোরের মধ্যে সে শহর ডাকটিকিটে এনে দাও কলকাতা গাইছিলে, সেই শহর? চিনতে পারবে হাজরার মোড়? বাসরুটগুলো মনে আছে? যা যে’রকম মনে আছে, তারা সব একরকম আছে তো? ইলতুৎমিশ, মনে হবে না তো, নতুন কোনও শহরে ঘুরতে এসেছ? তোমার সেই সিংহাসন কিন্তু আর নেই। যে হাতের তালুর মতো করে চিনতে শহরটাকে, সেই হাতের তালুর রেখা স্যানিটাইজার মেখে মেখে উঠে যায়নি তো? পর্যটকরা কেমন করে বাড়ি ফেরে, ইলতু মহারাজ? কেন তারা সব বন্দরে রাজ্য গেড়ে বসে বলো তো? কেন নিজেদের সাবধানবাণী তারা নিজেরাই কানে নেয় না? কেন? কেন কেন কেন?

ইন্টারস্টেটে চলবার সময় প্রায়ই একটা জিনিস চোখে পড়ে। বিশাল ট্রাকের পিছনে বাঁধা আস্ত বাড়ি। গোটা একটা বাড়ি। জানলা দরজা চিমনি বসার ঘর রান্না ঘর শোবার ঘর সমেত। বাড়ি মানেই কি স্থবির, ইলতু? বাড়ি মানেই কি স্থাবর? বাড়ি বুঝি তোমার সঙ্গে সঙ্গে চলতে পারে না? বাড়ি তোমায় বাড়ি নিয়ে যেতে পারে না? ফিরিয়ে আনতে পারে না? বাড়িতে? পারে। তেমন তেমন বাড়ি সব পারে। সঅঅঅব। I used to think I was some kind of a gypsy boy, before I let you take me home. মারিয়ানও কি বাড়ি নয়? So long, Marianne. সো লং, ইবন। যদ্দিন, তদ্দিন, হুঁ? এই যদ্দিন অসীম নয়, হ্যাঁ? হতে পারে না, কেমন? তদ্দিন। বাড়ি থেকে বাড়ি যাও। তারপর বাড়িতে ফিরো। ইবন বতুতার ভিতর একটা মাঝারি স্যুটকেস, একটা কালো গাড়ি, একটা মানুষ, আর একটা ছোট্ট, খুব ছোট্ট ফ্রাইং প্যান ঢুকে যায়। এইটুকুই তো বাড়ি। নয়? ইলতুৎমিশ। ভয় পেয়ো না। তোমার বাড়ি একদিন তোমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, “ইউ আর হোম।” অর্থাৎ, তুমি বাড়ি পোঁছে গেছ।

অর্থাৎ, তুমিই বাড়ি।