সব প্রাণীই কখনও না কখনও জেয়। অসুরক্ষিত। আঘাতব্য। দুর্বল। এতগুলো শব্দ ক্ষয় করে ফেললাম ভাল্‌নারেব্‌ল বোঝাতে গিয়ে। বারান্দায় বসে রোদ পোহাচ্ছি। একটা মাগনা কাঠের টুল পেয়েছি। তাইতে বসে। বেলা আড়াইটের রোদ আমার পশ্চিমমুখী বারান্দাতে সাঁতরে এসে আমার হাঁটু অবধি উষ্ণ করছে। ওতেই হবে। শেষ মে-তেও রোদ পোহাতে হচ্ছে। সামনের গাছের সারিতে অজস্র পাখি খড়কুটোর বাজারে দরদাম করছে। পরিষ্কার শুনলাম একটা তিড়িং পাখি ব্যাজার স্বরে বলছে, “তার চেয়ে গলা কাটো। এই যে গলা। কাটো।” ঝুঁটিওলা কার্ডিনালটা খড়কুটোর আড়তদার। সে মাগ্যিগণ্ডার বাজারে পেট চালানো নিয়ে একটা নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা আরম্ভ করল। নীচের তলার একটা মেয়ে তার দু’টো পেল্লায় কুকুরকে বের করেছে। দু’টোই পিটবুল। যখন তখন তরুণ বরুণ ছুট দেয়। ওজনতোলা মাংসপেশী। কুকুরদু’টো শুকনো পাতা শুঁকলো খানিক। তারপর দু’জন দু’মুখো হয়ে পিছনের পা ভাঁজ করে পেট পরিষ্কার করতে বসল। মেয়েটা আমাকে দেখতে পায়নি। যুগল পিটবুলের যে সভ্য আমার দিকে মুখ করে বসেছিল, সে সহসা চোখ তুলে তাকাতেই আমার সঙ্গে চোখাচখি হয়ে গেল। তখনই তার আঘাতব্যতা প্রকাশ পেয়ে গেল। এ’খানে বলে রাখা ভালো, এই শব্দটা আমি বানিয়েছি, ভাল্‌নারেবিলিটির এর চেয়ে তৃপ্তিকর বাংলা আমি পাইনি। যাই হোক। পিটুর মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। আমার চোখের থেকে চোখ সরাতে পারছে না সে। অপিরিচিতের সামনে হাগতে বসতে যে কুকুরদেরও এমন লজ্জা করে জানতাম না। সে না পারছে বসে থাকতে, না পারছে শান্তিতে হাগতে। তার চোখে মুখে মিনতি। মায়া হল। রোদের মায়া ত্যাগ করে ঘরে ঢুকে এলাম। আঘাতব্যতা সবারই আছে। তাতে ইন্ধন দেওয়া, তাকে জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেওয়া উচিৎ নয়। দুর্জেয় বীর ও তখন মাটিতে মিশে যেতে চায়।


সিগনাল লাল হয়ে আছে। ব্যস্ত চারমাথার মোড়। আমার পাশের লেন এ জনৈকা ফিটফাট তরুণী। মাথার উপর রোদচশমা। গাড়ির কাচ তোলা, কিন্তু কেমন যেন মনে হচ্ছে, কাচ নামালেই ভুরভুর করবে দামী কোনও গন্ধ। সেই মেয়েটি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে নাক খুঁটছে। পরম শান্তি। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি। অল্প অল্প করে যেন বুঝতে পারছি, আঘাতব্য না হতে পারলে এই চরম ব্যাপারটা আসে না। পৃথিবীর যত সুখ, যত পাওনা যেন এই একটা সিদ্ধান্তে লুকিয়ে আছে। খেলব হোলি, রঙ দেবো না, তাই কখনও হয়? বর্ম বড়ো অস্বস্তিকর একটা জিনিস। হ্যাঁ, তীর খাওয়া থেকে আটকাবে বটে, কিন্তু নিঃশ্বাস আটকে আসে আমার। ডুবুরির পোশাক পরে জলে নামলে ডুববার ভয় থাকে না, তেমন কঠিন হলে ছোটখাটো কামড়ও আটকে দেবে। কিন্তু হাফপ্যান্টের সমুদ্রস্নান যে বড়ো আরামের। মুখে নোন্‌তা, জ্বলে ওঠা চোখ নিয়ে তৃপ্ত পায়ে বুক জল থেকে কোমর জল থেকে হাঁটু, গোড়ালি পেরিয়ে থপথপ করে ভেজা-শুকনো বালির উপর থ্যাবড়ানো পায়ের ছাপ ফেলে উঠে আসা। সম্পূর্ণ ন্যাংটো হয়ে বাঁচতে পারলে বড় ভালো হত। ছোট্টরা যেমন বাঁচে। আহা, কী ভীষণ ভাল্‌নারেব্‌ল প্রত্যেকটি শিশু। মানুষ, অমানুষ। সব্বার শিশু। হাতি আঁকা জামা আর খালি পোঁদু নিয়ে সমীর যখন উদানমামা বলে টলোমলো পায়ে দৌড়ে আসে, ও ই তো বাঁচছে। আমরা টিকে আছে। যদিতে। যদি পরের মাসে স্টাইপেন্ড না দেয়? জমিয়ে রাখি বরং। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে! বিশ্বাস করো, তোমায় বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছে করছে। লোভ হচ্ছে একরকম। কিন্তু একটা ভয় টেনে রাখে। একটা যদির ভয়। যদি না হয়? যদি ঠকি? যদি না পারি? যদির উলটো দিকে কষ্ট আছে। থাকে, সাধারণত। জেনে গেছি। সমীর জানেনা। ভাগ্যিস।


জেনেশুনে যদি বিশ্বাস করি? করছি, কেমন? করছি কিন্তু। এক কলসি সাহস সংগ্রহ করেছি। দুরুদুর পেটে বিশ্বাস করেছি। করে আছি। কী যে ভালো লাগছে এ’রকম ভেসে থাকতে। যখন তখন ডুবে যেতে পারি। কিন্তু মনে হচ্ছে ডুবব না, জানো? জানি ডুবব না। বিশ্বাস করছি। ডুবব না। আঘাতব্য না হয়ে ভালোবাসা যায় না। হারাই হারাই, সদা হয় ভয়। শোনো, আমি বলছি। চার রকম উপায় আছে। এক, বর্ম। হারালে হারাবে। সে বর্ম ভেদ করে না ঢুকবে ভয়, না ঢুকবে সুখ। বাবার সব রকম মহাপুরুষার্থ ভাঁওতার পর্দা সরানো হিমুর মতন। নির্লিপ্তি। কিস্যু যায় আসে না, বুঝলে? হলে হবে, না হলেও হবে। দুই, প্রস্তুতি। ধরে নাও হারাবেই। হারাবেই। ধ্রুব। আজ আছে কাল নেই। শরৎচন্দ্রের গল্পের কন্যার পিতার মতো। প্রাণে ধরে মানুষ করছি বটে, বড্ডো রকম ভালোবাসছি, কিন্তু জানি, একদিন আর পাবো না দেখতে। তিন, আটকে রাখো। লুকিয়ে। বেঁধে। যেতেই দেবো না। দেবোই না। লাভ হবে না অবিশ্যি খুব একটা। উলটে সাত-তাড়াতাড়ি ভোঁভাঁ। চার, ভয়কে বলো, তোমার উপস্থিতি আমি স্বীকার করছি। আমি জানি তুমি আছো, তুমি থাকবে। তুমি বর্তমান, এবং তুমি অবিনশ্বর। তোমায় অগ্রাহ্য করছি না, তাই বলে তোমার হাতে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করবার বল্‌গাও দিচ্ছি না। বুঝেছ?


উলটো দিকের সিগনাল সবুজ থেকে হলুদ হয়েছে। পাশের গাড়ির তরুণী নাকের ফুটোয় তর্জনী নিয়েই এ’দিকে তাকালো। চোখাচখি হল। এক গাল হেসে ফেললাম দু’জনেই। সে হাতে মুখ ঢেকে হেসেই চলেছে। হেসেই চলেছে।