কিছু চাওয়া আর কিছু চাইতে চাওয়ার তফাৎটা আজ সকালে ইলতুৎমিশ আবিষ্কার করেছে। বা অনুধাবন করেছে। বারান্দায় বেরোলে সবাই ভাবুক হয়ে যায় কিনা!
শীত ছেড়ে যাচ্ছে। যাবার আগে ধাপ্পা-হুশ-টুকি খেলছে। গত সপ্তাহে কোথায় লুকিয়ে পড়ল। রোদ্দুরের চচ্চড়ি। মানুষজন পোঁটলা পুরে শীতের কাপড় আর ন্যাপথলিন গুছিয়ে রেখেছে। এমন সময় আলমারির পিছন থেকে ধাপ্পা দিয়ে পিলে চমকাল শীত। “আবার সে এসেছে ফিরিয়া” গোছের। ইলতু অগোছাল। সে জায়গার জিনিস সময়মতো জায়গামতো রাখে এই দুর্নাম তার কোনও বাজারে নেই। কালো শালটা বাইরের ঘরের একটা চেয়ারের উপর যেমন তেমন করে রাখা ছিল। কাজে দিল। সুমনের গুচ্ছ প্রশ্নাবলী মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ভদ্রলোক পলাশের ডাকনাম কে রেখেছিলেন, তা জানতে চেয়েছেন। ইলতু জানতে চায়, পলাশের ডাকনামটা কী? ভালোনাম অন্যকিছু, পলাশটাই ডাকনাম? নাকি ভালোনাম পলাশ? ডাকনাম? পুলু? তাই হলে সে ডাকনাম রেখেছেন বিভূতিবাবু। আপাততঃ আকাশ পরিষ্কার। ড্রায়ার থেকে সদ্য বের করা উষ্ণ কাপড়ের মতো। যত ঘনশ্যাম ডেকচিতে অল্প আঁচে ফুটছে। প্রয়োজনমতো ঘন করতে তাতে ময়দা গুলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বিকেলের মনখারাপের সময় এই ঘনশ্যামের উদয় হবার রেওয়াজ আছে। ভদ্রলোক বলে গেছেন। কিন্তু সকালের মনখারাপ যে আদতে একটা ঝকঝকে চিকনাই দিন, পরিমাণমতো গা শিরশিরানি, চোখ কুঁচকে আলোয় দাঁড়ানোর উষ্ণতার সঙ্গে সাইড ডিশে শাল জড়ানো ছায়ার শীতলতা, এবং সর্বোপরি বিরহ, সে’টা ইলতুৎমিশের উক্তি।
সকালে মেঘ করলে মন খারাপ হয় না। বিরক্তি হয়। তার থেকে পরিত্রাণ নেই। নেই। কিন্তু এ’রকম চেকনাই একটা সকাল দেখলে মনে হয় ভগবান বারফাট্টাই করছে। আরে হ্যাঁ হ্যাঁ জানি তোর বিশাল ফূর্তি। এ’রকম লোভ দেখাবি তাই বলে? ভগবান বলবে, “যাশশালা, মেঘলা করলেও ঝাড় খাবো, ফুটফুটে করলেও খিস্তি করবি, কী ভেবেছিস টা কী নিজেকে?” কথায় যুক্তি আছে। সিঁড়িতে বসে পায়ে রোদ লাগিয়ে ইলতুৎমিশ বললে, “এমন দিন বানা, যাতে প্রেম না পায়। রোদ থাকবে, কিন্তু কড়া। মিঠে নয়। হাওয়া টাওয়া দেবে না। ভুরু কুঁচকালেও ঘাম হবে। এমন দিন বানা, যাতে প্রেম না পায়।” ভগবান হাত তুলে বললে, “আমার কম্ম না। অমন দিন ঢের বানিয়েছি। ঘামতে ঘামতে বাড়ি ফেরার সময় ভেবেছিস, ইশ্, ও থাকলে চৌবাচ্চায় শুয়ে জল পোহানো যেত।” কথায় যুক্তি আছে। রেলিঙে কনুই রেখে ইলতুৎমিশ ভাবতে বসে। বা দাঁড়ায়। ওপাশে বিদ্যুতের তারের উপর একটা কাঠবেড়ালি হাজারও কসরৎ করছে। কাঠগোলাপের পাতা তিরতির করে কাঁপছে মৃদু হাওয়ায়। রাস্তার ওপাশের মস্ত কদাকার বাড়িটা তৈরী হচ্ছে, তার কাজ আজ বন্ধ। আজ রবিবার। যা কিছু জরুরী, সব মুলতুবি রেখে শহরটা রোদ পোহাচ্ছে। বাজে শহর। পচা রাজ্য। আর তো ক’দিন। তবু জানিনা সমানে কেন মনে হয়, হয়নি সময়। ইলতুর রাজ্যত্যাগ করতে চাওয়া উচিৎ। কোলাহলপুর থেকে নির্বাসিত একজন অবয়বহীন মানুষ কী করে বাঁশবনের রাজা হয়ে বসল, সে গল্প যারা ইলতুৎমিশকে চেনে, তারা জানে। কেউ তাকে রাজা বলে চেনে না বটে, কিন্তু রাজা একজন যে আছে, সে কথা তো সবাই জানে, বলো? বাঁশবনবাসের সময়সীমা হয়। সীমানা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসেছে অতর্কিতে। ধাপ্পা দিলো বলে। ইলতুৎমিশের খুশি হওয়া উচিৎ। ইলতুৎমিশ খুশি হতে চায়। খুশি কীসে হয়? বিরসবদনে রাজা ভাবে কী? তখনই তফাৎটা গোচর হল। ইলতু এইসিব চাইতে চায়। পাইনহাটার বাইরে বেরিয়ে একটা হট্টগোলাবাদ মার্কা শহরে ফের নামহীন হয়ে থাকতে চাইতে চায়। সত্যিই তো। কী আছে পাইনহাটায়? একটা আধা-ব্যস্ত বাসবাগান। দু’তিনটে গেলবার জায়গা। মনের মতো বাজার অবধি নেই। কাঁচালঙ্কাটা অবধি সেই কতদূর নৌকো করে গিয়ে নিয়ে আসতে হয়। পালাপার্বণের দিনে গোরস্থান হয়ে যায় পাইনহাটা। সে এইসবের থেকে মুক্তি চাইতে চায়। চাইতে চায়, কারণ এখনও চেয়ে উঠতে পারে নি।
কী আছে পাইনহাটায় প্রশ্ন করলে চোখ উল্টানি মুখ ভ্যাংচানি উত্তর আসে। কে আছে পাইনহাটায় জিজ্ঞেস করলে… রাস্তার ও’পাশের গলিটা দিয়ে একজন ছোটখাটো মানুষ কোট পাতলুন পরে কাঁধে পেল্লায় ব্যাগ ঝুলিয়ে সাইকেল চালিয়ে আসছে। ঝিরিঝিরি রোদে তার চুল খয়েরি হয়ে আছে। গলি-বড়রাস্তার মোড়ে যে গাছটা পাতাহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে বতুচূড়া বলে ডাকবে ইলতু এবার থেকে। আর ক’দিন যাক, দেখবে কেমন সাদা-গোলাপি ফুলে ছেয়ে যাবে গাছটা। শীত আসবার আগে আগে এই গাছটাই কেমন পাতাবাহার হয়ে যায়। সবুজ হলুদ কমলা লাল। এ বতুচূড়া নয়তো কে? ডানদিন বাঁ-দিক দেখে ইবন বতুতা ব্যাগ কাঁধে রাস্তা পেরোয়। বুঝি না। রবিবারেও কাজ কীসের? ঠাকুর পাপ দেবে। ঠাকুর উঁকি মেরে বলে, “ঘর পরিষ্কার করেছিস?” ইলতু মা কালীর মত জিভ কেটে ছোটে। ঝাঁট দেয়, বাসন মাজে, চাদর টানটান করে। ঘরে পেঁয়াজ রসুনের গন্ধ। সুগন্ধী মোমবাতি জ্বালায়। কে আছে জিজ্ঞেস করছিলে পাইনহাটায়? ওই যে, উঠছে সিঁড়ি দিয়ে। চাইনা যেতে মথুরায়। এই আমার গোঠ। ইলতুর বাঁশিতে সাওঁতালী সুর বাজে না। বাজে বৃন্দাবনী সারং। তিতুমীরের নাম ব্যারিকেডে থাকবে না, ইস্কুলের খাতার খয়েরি মলাটের উপর সাঁটা লেবেলে থাকবে। তিতুমীর, শ্রেণী এক, ক্রমিক নং সতেরো। ভিতরে সহজ পাঠ। ব্যারিকেডে থাকবে এর ঠোঁট আর ওর ঠোঁট। বাকি পৃথিবী যাক চুলোয়।
রবিবার সকাল। সুমনের আঙুল নাইলনের তার ছুঁয়ে ছুঁয়ে সরে যাচ্ছে। ইবন বতুতা কোথাও একটা কোনও একটা গাছে জল দিচ্ছে, কারও একটা খাতা দেখছে, ঢ্যাঁড়া, গোল্লা, নম্বর। ইলতুৎমিশ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছে পলাশের ডাকনাম তাহলে কী?