জায়গা আছে। সবকিছুর জন্য আলাদা আলাদা জায়গা আছে। সে’সব জায়গা জাগ্রত। মানত করতে হয় না, প্রণামী দিতে হয় না। বিশ্বাস করতে হয় কেবল। তা সে বিশ্বাস সকলেরই আছে। মনোহরদের বাড়ির উল্টোদিকে যে পুকুরটা, যাতে একশো বারো রকমের শ্যাওলা, নাকছাবিওলা কাতলা আর সোনার টিকলিওলা বোয়াল থাকে, তার ইঁট-বের-করা এককালে শান বাঁধানো পাড় হ’ল গানের জায়গা। এত সুন্দর কচুরিপানা আমি জন্মে দেখিনি। চাঁদের মত বদন হলে বলে ঠাকুমা বলে চাঁদপানা মুখ। আর এ পাতা সত্যিই কচুরিপানা। ছোট ছোট। গোটা পুকুরের জলে ভেসে আছে। পদ্মও আছে। ঠিক মধ্যিখানে। পোঁছনো যায়না। চেষ্টা করে দেখেছি। পদ্মগোখরোও আছে। ইয়াব্বড় কানা উঁচু কাঁসার থালার মত পাতায় গুটলি পাকিয়ে শুয়ে থাকে। তা থাকুক। মনোহরপুকুরের পাড়ের জন্য ভিড় হয়। আগে, আমার ছোটবেলায় ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ ছিল। এখন অত ভাগীদার নেই। খুব বেশি কেউ গান গায় না। আট প্রহর, আটজন মানুষ। কেউ না এলে ফাঁকা, তখন আমি বসি। সুনন্দ গোস্বামীকে মেটেমন্দিরের কীর্তনের দল থেকে বের করে দিয়েছিল, তার গলা সরু বলে। তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, ললিতার গানগুলি সে গাইতে পারে, তার বেশি নয়। সে এখন গোধূলি বেলায় গৌ থেকে উর অবধি পৌঁছতে যা কাজ দেখাচ্ছে গলায়, মেটেমন্দিরের ভিড় পাতলা হয়ে পুকুরের মশাদের ফিস্টি হয় রোজ। এর পরে নিকুঞ্জবনের জায়গাটা আসবে। আমি মনোহরদের বাড়ির ছাদ থেকে শুনছি। মনোহর বয়সে আমার ঠাকুর্দার চেয়েও বড়, কিন্তু আমার বন্ধু। হাফ প্যান্ট আর শাল জড়িয়ে আমার সঙ্গে ছাদের পাঁচিলে বসে। হাঁটু চুলকায়। ভূতেদের মশা কামড়ায় কিনা জিজ্ঞেস করেছিলাম ওকে, ও বলল কামড়ায় না, কিন্তু অভ্যেস। আমি একা একা কামড় খাবো, এ’টা নাকি ভালো দেখায় না। অনন্তকাল ক্লাস এইটের মনোহর। একদিন আমি বড় হয়ে যাবো। মনোহর হবে না।

ভোরবেলার পানাপুকুরের জলের উপর কোমরকুয়াশা হয়ে থাকে। সেই লুকোচুরিতে ইদানীং আশাবরী ধরেছেন নিখিলবাবু। জোড় চলছে। ঝালার পালা আসবার আগে আমার দাঁত মাজা হয়ে যাবে। শেষরাতের ওস্তাদ রশিদ। লোকটাকে আমি কখনও দেখিনি। শুনেছি। অত রাতে বাড়ির বাইরে বেরোনোর অনুমতি নেই। সুনন্দ ওঠবার পরে সিদ্ধার্থ নামে একটি ছেলে আসে গিটার নিয়ে। দিব্যি গান বাঁধে। প্রেমের গান। সবার ভালো লাগে না। আমার লাগে। মজা হচ্ছে, মায়াপুকুরের গান মায়া পুকুরেই শেষ। তার বাইরে কোথাও গিয়ে গাইতে গেলে গলা খোলে না। তার ছিঁড়ে যায়। তাল কেটে যায়। যারা মনোহরদের পুকুরে গাইতে আসেন, তারা গাইতে ভালোবাসেন বলেই আসেন। নাম বা টাকা কামানোর উপায় সে’খানে নেই। আমি একবার টেপ নিয়ে গেছিলাম। ঝিঁঝিঁ আর ব্যাঙের ডাক ছাড়া কিছু ওঠেনি।

আমাদের গ্রামে বাজারের মধ্যেই একটা চোরাবাজার আছে। সবাই জানে। কিন্তু কেউ জানেনা। কারুর কিছু কেনার বা বেচার না থাকলে সেই বাজারটা দেখতে পাওয়া যায় না। তুমি যদি ভাবো হাতের জাপানী টর্চটা বা চীনে ছাতাটা বিক্রি করবার নাম করে ঢুকবে, দেখবে কে কী বেচছে, কী কিনছে, সে গুড়ে বালি। ঢুকতেই পাবে না। আমি পারি। এমনিই পারি। কেন পারি জানিনা। ঢেঁকিরঘাটের কাছে এসে সারিনদী দু’ভাগ হয়ে গেছে। বড়সোঁতা, ছোটসোঁতা। প্রশাখা। ঠিক এই মোহনার মুখেই বাজার। একটা ছোটখাট শহরের মত বাজার। বাড়ির মতো দোকান, রাস্তার মতো গলি। বাবার সঙ্গে গেলে হারিয়ে যাই। একা গেলে হারাই না। সঙ্গে গেলে হারাই কারণ বাবাকে খুঁজে পাই না। রাস্তা ঠিকই চিনি। বাবাকে হারালে মাঝখানের সব বাজার টপকিয়ে ঢোকার মুখের ফেলুর জিলিপির কড়াইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। নারকোলের খোলে থকথকে গোলা। জিলিপি ভাজা খুব কঠিন। আমি পারিনা। বতু পারে। ঢুকেই দু’পাশে আমিষ সব্জির বাজার। পাইকারি আলু পেঁয়াজ আদা রসুন। তারপর কাঁচা সব্জি। গোল সব্জিদের পিরামিড। বাঁধাকপি। টমেটো। তরমুজও। কিন্তু সে’টা ফলের পাড়াতে। প্রায় সব ফলই গোল। কমলালেবু। মুসুম্বি। বেদানা। এই পাড়া ব্যাপারটাও ভালো। খাসিদের পাড়ায় দামড়া কচি মিলে কাঁঠালপাতা চিবোয়। সকালবেলা স্টেশন থেকে সাইকেল-খাঁচায় মুরগি আসে, তারা একটা মস্ত ঝুড়ির মধ্যে একরকম জালি তাঁবুতে থাকে। মস্ত হাঁড়িতে অল্প জলে মাছ খচমচায়। পায়ের ফাঁক দিয়ে অগণিত বেড়ালের আনাগোনা। বেড়ালরা সর্বগামী, সর্বময়। এই বাজার-শহরে কিছু কিছু বাড়ির পাড়া নেই। কোনা আছে। যেমন মুড়িওলার কোনা। ঢাউস বস্তায় কত্ত মুড়ি। উনুনে কড়াই। কড়াইতে বালি। বালিতে ছোলা, বাদাম, চাল। গরম মুড়ি খেয়েছ? এদের পাড়া নেই কারণ এরা একা। গামছাওলা। ওই একজনই গামছা বেচেন। গামছা, লুঙ্গি। মুড়িওলাও। এক, একক, একমেবাদ্বিতীয়ম। এই সব অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে কলতলার পাশ কাটিয়ে রকির গাছতলা-সেলুন আর বান্টির রেডিও-সারাইয়ের দোকানের মধ্যে দিয়ে টুক করে গলে গেলে চোরবাজারের দরজা। একবার ওপাশে গিয়ে একবার এপাশে এলেই গোটা বাজারটা চোরবাজার হয়ে যায়। সব্জিপাড়া হয়ে যায় মরা সাহেবের কোট পেন্টুলের পাড়া। খাসিপাড়ায় সাজানো থাকে কতরকমের বিলিতি মদ। মুরগিপাড়ায় মাটিতে বিছানো থাকে সারসার বন্দরফেরত বাহারি জুতো। ফলের পাড়ায় কিছু সোনার দোকান। মেছোপাড়ায় ইলেক্ট্রনিক্স। মুড়িওলা এই বাজারেও আছে। একই কোণায়। সে যে কী বেচে, জানিনা। শুধু কাছ দিয়ে গেলে সন্দেহজনক ভাবে ভুরু নাচিয়ে বলবে, “কী লাগবে?” যেন যা চাইব সব পাবো ওর কাছে। একদিন ঠিক করেছি মুড়ি চেয়ে দেখব। অনেকে অনেককিছু বেচতেও আসে চোরবাজারে। তারা ওই বাজারের দরদাম করা, “আড়াইশো? এইটুকু ট্যাংরা আড়াইশো? তুমি ডাকাতের দলে নাম লেখাও না কেন গণেশ? ভালোই তো গলায় ক্ষুর চালাতে শিখেছ!”, আর এই বাজারের “এই ক্ষুরটায় ধার আছে বলছ? টের পাবে না? আমি আবার ওর কষ্ট সহ্য করতে পারব না, ছটফট যেন না করে।” গণেশ বলবে, “ট্যাংরা বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি হয়ে যাবে মাখনমাস্টার, ট্যাংরা তেলাপিয়া সব। ইলিশ তো গেছেই মায়ের ভোগে। আড়াইশোয় পাচ্ছেন খেয়ে নিন, এর পর ভাতের থালা নিয়ে অ্যাকোয়ারিয়ামে গিয়ে হাঙরের পাশে সাঁতার কাটছে দেখতে দেখতে ঝোল মেখে খেতে হবে।” অথবা, “শুধু ক্ষুরেই কি সব হয়? হাতের যশ নেই? নইলে তো সবাই দিক্‌গজ হয়ে যেত অ্যাদ্দিনে।”

বাজারের পাশ দিয়ে আলের মত উঁচু পাকা রাস্তা চলে গেছে গ্রামের বাইরে। যাবার আগে একটা মাঠ রেখে গেছে। সেই মাঠের কাছে একটা কে-জানে-কত-পুরোনো বাতিঘর আছে। একটা বুলেটে ফুটিফাটা দেওয়ালও আছে শেষ প্রান্তে। লোকে বলে গোরারা ওখানে বন্দুক ছোঁড়া অভ্যেস করত। ইয়াম্মোটা দেওয়াল। রাইফেল ক্লাব বলে একটা বন্দুক ছোঁড়ার ক্লাব ছিল। নিশানা প্রতিযোগিতা হত। সে ক্লাব এখন ফুটবল, বসে আঁকো, আবৃত্তি, আর পুজোয় নেমে এসেছে। দেওয়ালের কাছে গোলপোস্টের পিছনে দোলনা আর স্লিপ রাখা নিয়ে বেশ হইচই হয়েছিল। ক’টা বল আর গোলের জালে জড়ায়। আর সে জালও কতদিন হল ছেঁড়া পড়ে আছে। সব দামড়া পায়ের বল দোলনা ঘেঁষে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে প্রতিধ্বনির মত। সে না হয় হল, কিন্তু শুক্‌নো ডাঙায় লাইটহাউস কেন ছিল, সে রহস্য ভেদ হয়নি। তবে কি আগে এই অবধি সমুদ্র ছিল? নাকি সারিনদীর কোনও খাত আসত এই অব্‌ধি? নদীর পাড়ে বাতিঘরের কথা কেউ কখনও শুনেছে? দিব্যি তালাবন্ধ বাতিঘর। এই গ্রামের সব মানুষ হয় তালাচাবির কারিগর, নয়ত চোর, নয়ত চলমান অশরীরী। কী একটা করে টঙে উঠে যায় প্রেম করতে। ও’টা প্রেমের জায়গা। ওখানে গেলে প্রেম হয়। সেই প্রেম নেমে এলে টেকে কিনা জানিনা।

মাঝেমধ্যে মনে হয় গ্রামে একটা পাহাড় থাকলে ভালো হত। নেই। তার বদলে স্টেশন আছে। সারিনদীর পুল পেরিয়ে। ওপারে। বাইরে সাইকেল রাখার ক্ষেত, আর রিকশার মজলিশ। স্টেশনের চত্বরে আমাদের গ্রামের একমাত্র চালু এবং ঠিকঠাক সময় রাখা বারোয়ারি ঘড়ি। ঠিকঠাক বলছি, কারণ হলদে দেওয়ালে কালোয় লেখা টাইমটেবিলে যে সময়ে ট্রেন আসবার কথা, দেখা যায় সেই সময়েই আসছে। এখন ট্রেনগুলো ঘড়ি মেপে চলে, না ঘড়িটা ট্রেন বুঝে আস্তে জোরে হয়ে সামাল দেয়, কে জানে। স্টেশনমাস্টার চড়াই পোদ্দার সন্ধ্যেবেলা একবার হনহন করে আর রাত্রে খাবার পর মৃদু পায়ে গোটা প্ল্যাটফর্ম জুড়ে পায়চারি করেন। আমার এমনিতে অন্য স্টেশনদের হিংসে হয়। চাওলা ঝালমুড়িওলা খবরেরকাগজওলা পেপসিওলা তো নেই, প্ল্যাটফর্মও মোটে একটা। আপ খ্যাঁকশিয়ালদা লোকাল অমুক নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে। শুনতেও কত ভালো লাগে। না। ডাউন মেচেদা লোকাল আসছে। ব্যস। চড়াই পোদ্দার আজকাল সে’টুকুও বলে না। শুধু মাইকের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলে, “আসছে।” কখন কোন ট্রেন আসে সবাই জানে। আর আমাদের গ্রামে কোনও বহিরাগত আসে না। তাই জন্য আমাদের গ্রাম নিয়ে কোনও গল্প নেই। মানচিত্রে উল্লেখ নেই। নামটা পর্যন্ত নেই। টলস্টয় বলে গেছেন, যে কোনও ভালো গল্প হয় একজন আগন্তুকের আগমণ নিয়ে, অথবা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার। আমি বেরিয়ে পড়ব। অনেকদিন বাদে, নে আর ক এর মাঝখানে আটটা এ, এতবড় অনেকদিন বাদে ফিরব। আমাকে কেউ চিনতে পারবে না। আমি তখন আগন্তুক। এক ঢিলে দুই পাখি। এ ম্যান গোজ অন এ জার্নি, অ্যান্ড এ ম্যান কাম্‌স টু টাউন। যাই হোক, এই স্টেশন হল আঁকার জায়গা। এই স্টেশনে আমি বতুকে প্রথম দেখি।

লাইনের এই পারে খটখটে রোদ্দুর। ওইপারে ম্যাজমেজে বৃষ্টি। স্টেশনে বসে গ্রামের দিকটা দেখা যায় না। পিছন ফিরে রয়েছে। ওইপারটাই দেখা যায়। ওইপারটা অন্য গ্রাম। অন্য দেশ। অন্য গ্রহ। প্ল্যাটফর্মে আসন পেতে বসে আঁকছি। আঁকার খাতা বাইরে নিয়ে গেলেই ফের শূন্য হয়ে যায়। তাই খাতার বদলে পাতাতেই হত। কিন্তু খাতা ভাবতে ভালো লাগে। বতু আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে আছে। এতক্ষণ মুখোমুখিই ছিল। এখন ঘুরে গেছে। তাই আমার আঁকাও আর এগোচ্ছে না। ওর খাতাটা ভারী। বাইরে গেলেও ফাঁকা হয়ে যায় না। পেন্সিলের উপর কাঠকয়লা দিয়ে কীসব করে। বুড়ো আঙুলের ধার দিয়ে ঘষে, মোছে। বলে, ভালো আঁকিয়েরা কখনও ইরেজার ব্যবহার করে না। আমি জানতে চেয়েছিলাম, ভুল করে না কখনও? মাথা নেড়ে বলেছিল, “ভুল বলে কিছু হয় না। অন্যের আঁকা দেখে আঁকলে হয়। নতুন জিনিসে আবার ভুল কী? ভুল হচ্ছে যে’টা আগের মত, আসলের মত হয়নি। যার আসল নেই, যে নিজেই আসল, তার ভুল কী?” আমার বাবা ভুল হয়। খুব মন দিয়ে ভুরুটুরু কুঁচকে বতুকে আঁকছিলাম। বাঁ চোখটা দিব্যি হয়েছে। ডান চোখটা হয় ছোট, নয় বড় হয়ে যাচ্ছে। একবার মাপে মাপে হলও। কিন্তু মণিটা ট্যারা হয়ে গেল। বতু ট্যারা নয়। তার টোল পড়ে না। তার গজদাঁত নেই। ডান চোখটা চুল দিয়ে ঢেকে দিয়েছি। মুখের উপর চুল এসে পড়েছে। নে এবার। বতু ছবি আঁকছিল। কীসের, কে জানে। শেষ না হলে দেখাবে না। আমি বতুর ছবি আঁকার ছবি আঁকছিলাম। চুলের গোছা কানের পিছনে গুঁজে ঝুঁকে পড়ে পেন্সিল ঘষছে। চশমা নাকের ডগায়। ব্লাউজের ভিতর আলোছায়া দু’জন বুক ঘেঁষাঘেঁষি করে গল্প করছে। ওদেরই আঁকছিলাম, বতু চোখ তুলে দেখল আমি ওর বুকের দিকে নিবিষ্ট চিত্তে তাকিয়ে আছি। অভিপ্রায়টা দেখল না। ভুরু কুঁচকে, মুখ ভেংচিয়ে ঘুরে বসল। আমি কি এখন ওর পিছন আঁকব? চোখ বুঁজে মনে করবার চেষ্টা করলাম, কেমন দেখেছিলাম। পেটের ভিতর গুড়গুড় করে উঠল। মনে মনে বললাম, আমি তো আলোছায়া আঁকছি। তা বই তো না। অপবিত্র পবিত্রবা। আঁকতে আঁকতে আনমনা হয়ে যাই। মাথার মধ্যে অ্যাক্রাইলিক শব্দটা পাক খেতে থাকে। ওপারে একটা পাখি ধ্যাত্তেরি ধ্যাত্তেরি বলে ডাকছে। এমন সময় কানের একদম কাছ থেকে শুনলাম, “কই কী আঁকলি দেখি?” ঝটপট খাতা লোকাতে যাবো, তার আগেই ছিনিয়ে নিল। সাদা পাতায় একটা নীচের দিকে তাকিয়ে থাকা চুলে ঢাকা আদুরে আঁকা মুখ, আর খুব পরিপাটি, সাবধানে, যেন ছুঁলেই সর্বনাশ, নিখুঁত নিটোল দু’টো আলোছায়া। কাঁধ থেকে হাত নেমে বুকের কাছ অবধি এসে শেষ। খানিকটা নীচে আঙুলগুলো। মাঝখানটা কই গেল? পেট? খাতা? পা? বতু খুব হাসল। আমার কান গরম। হাসি থামিয়ে রাগরাগ মুখ করে বলল, “ফেরত পাবি না এ’টা।” বলে গটগট করে বেরিয়ে গেল। আমিও উঠলাম। ওকে বেরিয়ে যাবার সময়টুকু দিয়ে। ও যে’খানে বসে ছিল, কমলালেবুর খোসা চাপা দেওয়া একটা পাতা। পাতার ভিতর আমি। লোহার থামে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছি। তলাই সই করা।

জায়গা আছে। সবকিছুর জন্য আলাদা আলাদা জায়গা আছে। সেই সেই জায়গায় সবাই সবকিছু পারে। পুকুরপারে গান গাইতে পারে। স্টেশনে আঁকতে পারে। কেউ কেউ জায়গার বাইরে গিয়েও পারে। এই যে শম্ভুভিখিরি প্ল্যাটফর্মের কানা থেকে পা দুলিয়ে দুলিয়ে দেখো রে নয়ন মেলে গাইছে? তাই শুনে যে পরের ট্রেনেই উঠে পড়ে জগতের বাহার দেখতে যেতে ইচ্ছে করছে? এই স্টেশনের বাইরেই দুধ-চা লাল-চা আদা-চা লেবু-চা ঘটিগরম বিক্রি করতে বসে নিধুকাকু? তার জন্য যে গ্রাম ছেড়ে বেরোতে ইচ্ছে করে না? এই যে সারিনদীর সাঁকোর তলায় চ্যাপ্টা পাথরটাতে বসেও কী সুন্দর তালগাছ আর বাজারের থলে হাতে মানুষ আরও কতকিছু এঁকে ফেলে বতু? এই যে বাতিঘরে না গিয়েও বতুকে আমি ভালোবাসি?

পড়ার টেবিলে দিস্তা খাতার তলায় ডায়রিতে ছাড়াও আমি লিখতে পারি কিনা, পরখ করে দেখতে হবে।

ইতি,
ইলতুৎমিশ