কালকে রাত্রে একটা আজব স্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম, একটা স্টেগোসরাস ফোঁসফোঁস করে পায়চারি করছে, আর সামনে একটা টিরানোসরাস অধোবদনে গরুচোরের মত দাঁড়িয়ে আছে। আর এক পাশে তিনটে ছানা ভেলোসির‍্যাপ্টর উচ্চিংড়ের মতো লাফাচ্ছে, একে অন্যের ঘাড়ে পড়ছে। দেখে মনে হ’ল টিনএজ র‍্যাপ্টর তারা। তাদের মা র‍্যাপ্টরটা উচ্চকণ্ঠে নালিশ জানাচ্ছে। “এ’টা কি একটা কাজের কাজ হল, বলুন? ওরা তিনজন মানুষগুলোকে কব্জা করে এনেছিল প্রায়। ওদের কাপড়ে-চোপড়ে হয়ে যাবার জোগাড়, মাঝখান থেকে টিনু এসে আমার ছেলেদের উপরে হামলে পড়ল। কতটা দাঁত বসিয়েছে দেখুন!” দেখলাম একটা ছানা র‍্যাপ্টরের গলায় ব্যান্ডেজ। “-তারউপর মানুষগুলোও পালিয়ে গেল গোলমালে।” স্টেগোসরাসটা মাথা আর ল্যাজ দুলিয়ে বলল, “না, না। এতো বিশৃঙ্খল হলে কেমন করে চলবে?” একটা ছানা র‍্যাপ্টর উৎসাহ পেয়ে ফরফর করে ইংরেজিতে বলল, “ডুড! পিক সামওয়ান ইয়োর ওন সাইজ। আমাদের তিনজনের ওজন তোর থেকে কম।” টিরানোসরাসটা খুব লজ্জিত মুখে মিনমিন করে স্যরি বলতে বলতে বসেই পড়ল থেবড়ে। খুদে খুদে হাতগুলোকে নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। র‍্যাপ্টরছানা গুলো বকেই চলেছে। “সাহস থাকে তো যা না, স্পাইনোর সঙ্গে লড় গিয়ে। তখন তো ঠ্যাঙের মধ্যে ল্যাজ গুটিয়ে…” টিনু ফুঁপিয়ে ঊঠল। দেখে আমার খুব হাসি পেয়ে গেল। হাসি শুনে দেখি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার ভয়ে হাত পা হিম হয়ে গেছে। তারপর দেখি আমি একটা গাছের উপর বসে আছি। নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম আমি টেরোডাক্টিল হয়ে গেছি। ভয়ানক ফাঁপরে পড়লাম। আমি ছেলে না মেয়ে বুঝতে পারছি না। ভয়ের চোটে হাগু পাচ্ছে। কিছু করতে পারছি না, যদি ডিম বেরোয়? এ’দিকে সবার রাগ কীভাবে আমার উপর এসে পড়েছে। বলছে “এই একটা আপদ। কোনও কাজ করবে না, কারুর উপকারে লাগবে না, সারাদিন উড়েউড়ে টিকটক ভিডিও বানাবে!” আমি তাজ্জব। আমি যে গাছটায় বসেছিলাম, সেই গাছটাই একটা ব্রন্টোসরাস খাচ্ছিল। সে জাবরকাটা থামিয়ে বলল, “এই দেখ!” দেখলাম আমি সহ কয়েকটা টেরোডাক্টিল উড়ছি, পিছন থেকে একটা কে ভিডিও করছে। আর জুরাসিক পার্কের থীমটা বাজছে। খুব লজ্জা লাগল। উড়ে চলে গেলাম। ছিছি।


উড়তে উড়তে দেখি নীচে কোথা থেকে কার একটা ফোনের রিং টোন বাজছে। তাকিয়ে দেখি একটা নদীর পাড়ে কে একটা হেগে রেখেছে। যদ্দূর মনে হয় স্পাইনোসরাসটা। ঢিপির মতো হাগু। সেখান থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। আর একটা লোক সেই হাগু হাতড়ে একটা ফোন বের করে এনেছে। সেই ফোনটা বাজছে। মানে সেই জুরাসিক পার্ক টু এর সীনটা। এইসব দেখে আমারও পেয়ে গেল। আমিও যা হয় হবে ভেবে উড়তে উড়তেই করে দিলাম। নাহ, ডিম বেরোল না। কিন্তু টিপ করে ওদের নৌকার উপর গিয়ে পড়ল। তখন বুঝতে পারলাম পাখিরা কেন গাড়িতে, মূর্তির মাথায়, লোকের টাকে হাগতে এত আনন্দ পায়। মলত্যাগ ইজ এ স্পোর্ট ফর পাখিস। যাই হোক, লোকগুলো নৌকা করে এগোচ্ছে। আমি অনুসরণ করছি। উপর থেকে দেখতে পাচ্ছি স্পাইনো জলের তলা দিয়ে কুমীরের মতো এগোচ্ছে। আমি নীচে নেমে গিয়ে ওডের সাবধান করতে গেলাম, কিন্তু ওরা বৈঠা দিয়ে আমার নাকে মারল। উজবুকের দল! মর! স্পাইনো যথারীতি উঠেছে। নৌকো উল্টেছে। পোঙাপাকা বৈঠা-খেদানো বাবা টাইপের লোকটাকে খেতে যাবে, টিনু কোত্থেকে বেরিয়ে এসে গোঁত্তা মারল স্পাইনোকে। লে হালুয়া। মালটার মাথায় জাস্ট কোনও বুদ্ধি নেই। র‍্যাপ্টরগুলো বার খাইয়ে দিয়েছে, ও-ও খেয়ে গেছে। স্পাইনোর এমনিতেই মাথা গরম ছিল। অনেক কষ্ট করে পিরামিড আকারে হেগেছিল, মানুষগুলো নষ্ট করেছে। তারউপর টিনুর বেয়াদপি। (এ’খানে উপলব্ধি করলাম যে মলত্যাগ ইজ এ স্পোর্ট ফর নট জাস্ট পাখিস।) ঘ্যাঁক করে কামড়ে দিল টিনুকে। মানুষগুলো পড়ি-কি-মরি করে দৌড়চ্ছে। স্পাইনোরও হাত ছোট, কিন্তু টিনুর মত নয়। টিনু তার ছোট হাতের জন্য খুব হীনমন্যতায় ভোগে। স্পাইনো তাতেই আঘাত করল। স্পাইনো টিনুর চেয়ে লম্বা। উঠে দাঁড়িয়ে টিনুকে এক থাবড়া মারল। টিনু কামড় আশা করেছিল। বিরাশি হাজার জ্বালা ধরানো ফোস্কার মত থাপ্পড় আশা করেনি। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। স্পাইনো একগাল হেসে বলল “ইউ ডিড নট সী দ্যাট কামিং, ডিড ইয়া?”


সন্ধ্যে হয়ে গেছে। মানুষগুলো দ্বীপ ছেড়ে চলে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। টিনু এতক্ষণ একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছিল। এখন সে’টা ফোঁপানোয় এসে ঠেকেছে। মায়া হচ্ছিল বেচারার জন্য। এতক্ষণ ওর সঙ্গেই ছিলাম। সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম। “তুই সবার রাজা, বুঝলি? তোকেই মানুষ সবচেয়ে বেশি মনে রাখবে। চিনবে। তোকে নিয়ে গল্প বানাবে, কীভাবে তুই মানুষদের উদ্ধার করতিস। কাঁদিস না টিনু, কাঁদতে নেই। এত ধেড়ে ডাইনোসর তুই, কাঁদতে আছে?” ক্রমে বুঝলাম, মানুষরা কে কী ভাবছে তাতে ওর কিছু যায় আসে না। ডাইনো সমাজে ওর ইমেজ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। আমি খানিকক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা টিনু, তুই এ’রকম করিস কেন? অন্যরা মানুষ ধরতে গেলেই তুই বাগড়া দিস কেন? নিজে তো কম মানুষ খাসনি!” টিনু অবাক হয়ে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “ট্যারা! ট্যারা তোর ডিম নিয়ে পালাচ্ছে ওই দ্যাখ!” আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখি সত্যি তাই! ইন্ডিয়ানা জোন্‌স এর মতো দেখতে একটা লোক আমার বাসা থেকে একটা ডিম নিয়ে পালাচ্ছে। মুহূর্তে সব মনে পড়ে গেল। আমি বাবা। আমার একটা বউ আছে। আর ডিম আছে। ডিমটা পাহারা দেবার দায়িত্ব ছিল আমার। চুরি যাওয়া ডিমটা ফেরত না আনতে পারলে আমার ঘাড়ে মাথা থাকবে না। লোকটা দৌড়ে সমুদ্রের পাড়ে পৌঁছে গেছে। সে’খানে অবিকল একটা হাওড়া ব্রিজের মতো ব্রিজ। লোকটা সে’টা পেরোচ্ছে। পেরিয়ে মিলেনিয়াম পার্কে ঢুকে গেল। একটা লোক বেঞ্চিতে বসে ছিল। তারপাশে গিয়ে বসল। আমি দূর থেকে দেখছি। পিছন ফিরে দেখি আইলা নুবলা হাওড়া হয়ে গেছে। অর্থাৎ আমি আর ফিরতে পারব না। বাঁচা গেছে। ডিম যাক তাওয়ায়, আমি কলকাতা দেখতে বেরোলাম। ছাদে ছাদে লোকজন বাচ্চাকাচ্চা আমার দিকে আঙুল তাক করে দেখাচ্ছে আর বৃহচ্চঞ্চু বৃহচ্চঞ্চু বলে চেঁচাচ্ছে।


পিছনে জুরাসিক পার্কের থীম বাজছে।