ছোট্ট গরাদ দেওয়া জানালার ওপারে চেয়ারেই হাত পা ছড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে আয়েশ করছিল টিকিট কাউন্টারের লোকটা। ইলতুৎমিশের মুখটা দেখে মাঝ হাই এ চমকে বিষম খেয়ে উঠে ভারী বিরক্ত গলায় বলল, “কোথায় যাবে?” “প্ল্যাটফর্মেই থাকব।” বলে ইলতুৎমিশ হাত বাড়িয়ে দিল গরাদের নীচের ইঁদুর গর্তটা দিয়ে। সেই বাড়ানো হাত থেকে টাকা নিয়ে বিরস মুখে একটা প্ল্যাটফর্ম টিকিট ধরিয়ে দিল লোকটা। তারপর বাকি হাইটা তুলল। চেয়ারে বসে ঘুমোনো অধ্যবসায়ের কাজ। সবাই পারে না। কেউ কেউ পারে। ভৌতিক গল্পের যোগ্য রেলস্টেশনের টিকিটবাবুরা পারে। হাইকোর্টের জজেরা পারে। কলকাতার ফ্ল্যাটের বাইরে বসে থাকা দারোয়ানরা পারে। খুব খুব মাঝেসাঝে পাহাড়ী রাস্তায় চলন্ত বাসের ড্রাইভাররা পারে। ইলতুৎমিশ দেখেছে। মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে উঠে দেখেছে সে একাই জেগে। আলগা হাতে স্টিয়ারিং ধরে মাথা এলিয়ে দিয়ে মুখ হাঁ করে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে ড্রাইভার। ভয় কাঠ হয়ে গিয়ে তার আর জাগানো হয়নি। উলটে নিজেও ঘুমিয়ে পড়া শ্রেয় মনে করেছিল ইলতুৎমিশ। ঘুমের মধ্যে মরে যাওয়াই শ্রেষ্ঠ মরণ। এই সব কথা ভাবতে ভাবতেই সে প্ল্যাটফর্ম টিকিট হাতে পায়ে পায়ে রেললাইনের কাছে এসে দাঁড়াল। প্ল্যাটফর্মের কিনারায়।
প্ল্যাটফর্মের কিনারাতেই একটা লোক লুঙ্গি পরে উবু হয়ে বসে দাঁতন করছে। খুব মন দিয়ে করছে সে কাজটা। নিমের ডালটা ছিবড়ে হয়ে এসেছে। ইলতুৎমিশ কখনও নিমের ডাল দিয়ে দাঁতন করেনি। নিম টুথপেস্ট দিয়ে ব্রাশ করেছে। সে তার পাতলুনটা হাঁটুর কাছে গুটিয়ে নিয়ে উবু হয়ে বসল। এখন একটা নিমের ডাল দরকার। নিমপাতা দেওয়া ডাল সে খেয়েছে। সাধারণ শুক্তো নয়। লাউ, উচ্ছে নেই। নিমপাতার ফোড়ন দেওয়া ডাল। ইচ্ছে করে খেয়েছে তা নয়। ফ্রিজের ভিতর পাশাপাশি দু’টো প্লাস্টিকের থলেতে এক আঁটি কারিপাতা আর এক আঁটি নিমপাতা ছিল। আর ছিল তার বিশ্ববিখ্যাত অন্যমনস্কতা। মানুষে পার্সলে আর ধনেপাতা গোলায়। ইলতুৎমিশ সাধারণ মানুষ নয়। একেবারে ধারটায় বসে থাকতে ভালো লাগছে। এই পড়ি এই পড়ি একটা অনুভূতি। তিনখানা লাইন, তার আর ওপাশের প্ল্যাটফর্মের মধ্যে। এক কোণে, মাঝখানের লাইনে একটা অলস ইঞ্জিন দাঁড়িয়ে ঝিমোচ্ছে। চালু ইঞ্জিন। ঘরঘর শব্দ করছে। তার চালক ভিতরে চাবি রেখেই হিসু করতে গেছে। হয়ত। কে জানে। ইলতুৎমিশের খুব ইচ্ছে হল ইঞ্জিনটা নিয়ে কেটে পড়ে। ছোটবেলায় মালগাড়ির চালক হবার বাসনা ছিল তার। তার জন্যও পড়াশোনা করতে হয় জেনে পিছপা হয়ে এসেছিল সে। স্টেশনে এলে এ’রকম নানারকম ইচ্ছে তার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বেশিক্ষণ উবু হয়ে বসলে পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে যায়। আরও বেশিক্ষণ বসলে হাগু পেয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। ইলতুৎমিশ উঠে একটা সিমেন্টের বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। নিম-দাঁতন-ওলা কখন গায়েব হয়ে গেছে।
ছোট স্টেশন। মাঝখানে ছাউনির তলায় বসে ডাইনে বাঁয়ে মাথা ঘোরালে দুই দিকের হলুদ নিশানাফলকে কালোয় লেখা অবার্নপুর দিব্যি পড়া যায়। আর কিনারায় এসে মাথা বাড়ালে সিগনাল বাড়িগুলোও দেখা যায় বেশ। অবার্নপুর ইস্ট। অবার্নপুর ওয়েস্ট। পুরোনো লাল ইঁটের ছোট্ট বাড়িগুলো। পায়ের কাছে আগাছা। আর চকচকে লাইনের মাঝে পাথরকুচি। পাশের বেঞ্চিতে একটা ক্ষয়াটে লোক আধশোয়া হয়ে আছে। ইলতুৎমিশ জানে এই ধরণের মানুষগুলো কোনও ট্রেনের অপেক্ষা করে না। পারতপক্ষে চোখ মেলায় না কারও সঙ্গে, কথার উত্তর দেয় না। এদের চাকরি গেছে। বাড়িতে বলবার সাহস হয়নি। রোজ টিফিনবাক্স ফাইলপত্তর গছিয়ে সময়মতো বাড়ি থেকে বেরোয়। তারপর এ’রকম জনবিরল স্টেশনে এসে বসে থাকে। দাঁত খোঁটে, নাক খোঁটে। পা চুলকায়। এইধরণের প্রজাদের ঘাঁটায় না সম্রাট ইলতুৎমিশ। নইলে এ তো তারই রাজ্য। আর কেউ হলে তাকে সেলাম ঠুকত। ঘুমঘুম গলায় ঘোষণাওলা কিছু একটা বলছে। গলা শুনে মনে হচ্ছে টিকিটবাবুই। একটা বাবুইপাখি জানালার কাছে বাসা বেঁধে আছে। ঠোঁটে করে নোট নিচ্ছে, টিকিট আর খুচরো ফেরত দিচ্ছে। আর মাইকের কাছে মুখ নিয়ে কিচিরমিচির করছে। টিকিটবাবুই। কী বলল? আসছে না বলল? কোন ট্রেন? কোনটা ক্যানসেল হল? কী মুশকিল! ইলতুৎমিশের অলস শিরদাঁড়া ঋজু হয়। প্রখর হয়ে ডোবারম্যানের মত কান পাতে সে। তারপর স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে। হাওড়া ধানবাদ কিছু একটা। সেইটা বাতিল হয়েছে। হোকগে। মুহূর্তের মধ্যে ইলতুৎমিশ ফের ভাসারম্যান হয়ে যায়। সময় নামতা অনুযায়ী এখনও এক আধকে আধঘন্টা বাকি।
আধ এক্কে আধবছর দেখা হয়নি। সে’খানে কী করে যেতে হয়, সে-ই জানে কেবল। ভরসার কথা, সে ফিরতেও জানে। আর ইলতুৎমিশ জানে অপেক্ষা করতে। একটা বাদামভাজাওলা পাওয়া গেলে ভালো হ’ত। বারবার উঠে খাদের কিনারায় গিয়ে বকের মত মাথা বার করে চাইলেই বুঝি তাড়াতাড়ি চলে আসবে ট্রেন? ইলতুৎমিশ চোখ খুলে ঘুমোতে লাগল। মার্টিন কোম্পানির একটা পেল্লায় বাষ্পইঞ্জিন এক কুয়াশা ধোঁয়া ছেড়ে এসে দাঁড়াবে। ফাঁকা প্ল্যাটফর্মের কুলিদের ভূতগুলো শরীর পাবে। শয়ে শয়ে যাত্রী নামবে ট্রেন থেকে। ইঞ্জিনটা ধুঁকবে। ফুঁসবে। ভেবেই শীত শীত করছে। দিনেতে অন্ধকার করে আসছে। এক জগৎ সাদাকালো চলচ্চিত্রের মধ্যে একটা রঙিন স্থিরচিত্র দেখতে পাবে ইলতুৎমিশ। গাঢ় সবুজ হাঁটুঝুল জামা। যে’টা খুব মানায়। খয়েরি চশমার ফ্রেম। যে’টা একেবারে মানায় না। এক আধটা পোঁটলা পুঁটলি। কুঁচকানো ভুরু। সন্ধানী দৃষ্টি। ইলতুৎমিশ মনের মধ্যে কে প্রথম (ভিড়ের মধ্যে) খুঁজে পেয়েছি খেলা খেলতে লাগল। আর প্রতিবারই জিততে লাগল। উজ্জ্বল হলুদ একটা ওই-তো আলো তাকে সাহায্য করতে লাগল। আজব খেলা। প্রতিপক্ষ জানেওনা সে খেলছে। তার ধারণাই নেই যে এ’রকম একটা খেলা হচ্ছে। উফ্, কোন কোচে আসছে সে’টাও জানা হ’ল না। সবে আট মিনিট হয়েছে? পৃথিবীর সব ঘড়ি একসঙ্গে খারাপ হ’ল? বন্ধ ডেকেছে? একটা প্রতাপশালী ধ্যাত্তেরিকা চোঁয়া ঢেঁকুরের মত উঠে এল ইলতুৎমিশের গলা দিয়ে। সে যে গতিতে পা নাচাচ্ছে, পা হাওয়ার বদলে ডাঙায় পড়লে একশো মিটারে মেডেল বাঁধা ছিল। এখন উপকার হচ্ছে এই, যে মশাগুলো ঘেঁষতে পারছে না। তার দিব্যদৃষ্টি খাঁচা ছেড়ে উড়ে গিয়ে দেখে এসে বলল, “এস ট্যুয়েল্ভ, চুয়ান্ন নম্বর। আই বতুতা। তবে বারো মিনিট লেট, হোগান্সভিল আর লাগ্রাঞ্জের মধ্যে আছে, টুকুর টুকুর করে এগোচ্ছে। অ্যালাবামা ঢুকল বলে।” ইলতুৎমিশ একটা নিশ্চিন্তের হাসি হাসল। আর সে’টাই তার কাল হ’ল।
ইবন যখন ট্রেন থেকে নামল, ইলতুৎমিশের হাঁ করা মুখের তলার ঠোঁটে একটা মাছি কিছু খুঁজছিল। বাড়ি-পালানো-অফিসে-খ্যাদানো লোকটাকে চমকে দিয়ে তার ডানকান টেনে দিল ইবন বতুতা। ইলতুৎমিশ চমকে উঠে বসে থু থু করে মাছিটাকে তাড়িয়ে একগাল হেসে বলল, “ও, তুই এসে গেছিস?” ইবন তার মুখের বিপদজনকরকম কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, “আমি জিতে গেলাম তো ইলতু!”