পেঁচা হবার প্রথম শর্ত হল ঘাড় তিনশো ঊনষাট ডিগ্রী ঘোরাতে পারতে হবে। ইলতুৎমিশের ঘাড় তিনশো বাহান্ন ডিগ্রী ঘুরছে। সারারাত দু’চোখের পাতা এক হয়নি। এখন সকালে মনে হচ্ছে চোখের পাতা বলে কিছু নেই। ইয়াব্বড় গোল গোল চোখ হয়ে আছে। সে চোখের দিকে তাকালে রাস্তার সব গাড়ি থেমে যাবে, এমন লাল। মাথার চুল বর্ষাকালে শর্ট সার্কিট কলিং বেলে হাত দিয়ে শক খাবার মত পর্যায় চলে গেছে। মুরগীর মত, পেঁচার মত, কাঠবিড়ালীর মত দ্রুত ঘাড় নড়ছে। কারণ চোখের মণি স্থির। তাই এ’দিক ও’দিক কিছু দেখতে হলে ঘাড় সমেত চোখ নিয়ে যেতে হচ্ছে। হাত কাঁপছে। তিরতির করে। যেন লো ভোল্টেজ বিদ্যুৎ বইছে ভিতরে। চিন্তাগুলো কানের ফুটো নাকের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। ঘুমোতে হবে। প্রয়োজন। কিন্তু আসছে না ঘুম। আসছে না, আসছে না, আসছে না। অথচ ক্লান্ত লাগছে। ইলতুৎমিশ ঠিক করল ঘুমের ওষুধ খাবে। ওষুধ নেই। বানাতে হবে। সহজ কাজ।
হাঁড়িতে বগবগ করে চাল ফুটছে। উপরে ভেসে একটা ডিম। অনতিদূরে জিরিজিরি করে আলু কেটে রাখা আছে। একটা কড়ায় সাদা তেলে বুড়বুড়ি কাটছে কিছু কালো জিরে আর একটা লাল হয়ে যাওয়া কাঁচা লঙ্কা। তাকে পাকা লঙ্কা বলবে কিনা ভাবতে ভাবতে ইলতুৎমিশ আলুর গায়ে হলুদ করল। তার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিল। তারপর নিতান্ত অনাদরে নামিয়ে দিল কড়ায়। একটুও তেল ছিটল না। ঘুমের ওষুধ সে আজ প্রথম বানাচ্ছে না।
ভাতের ফ্যান গালা কঠিন কাজ। বহু বছরের সাধনা আর অধ্যবসায় প্রয়োজন। সে শিখেছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাতের ফ্যান তান্ত্রিকের কাছে। সে নিজে ঊনশ্রেষ্ঠ। ভাবতে অবাক লাগে, একই বাড়িতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আর ক্যাবলাতম ভাতের ফ্যান গালিয়ের অবস্থান। ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে ঢাকনি শুদ্ধু হাঁড়ির কানা ধরে অবলীলায় কাত করে দিতে পারে মা। ফ্যান বেরিয়ে একটা কানা উঁচু অ্যালুমিনিয়ামের থালায় পড়ে। সেখান থেকে সাদা বাষ্প বেরিয়ে আচ্ছন্ন করে রাখে রান্নাঘর। নিঁখুত। বাবাকে একদিন ফ্যান গালতে দেওয়া হয়েছিল। টুথপেস্ট শেষ হয়ে গেছিল হাতের ফোস্কা আটকাতে। আর বিন্দুমাসি কাজ করতে এসে মেঝেতে পড়ে থাকা ফ্যানে পা হড়কে মেঝেশায়ী হয়েছিল। ইলতুৎমিশ ছোট থেকেই তাই মায়ের ফ্যান।
স্টিলের কানা নীচু থালায় বিড়াল ডিঙোনো ভাত। চামচ থেকে নিঙড়ে নেওয়া গাঢ় বাদামী ঘি। ইতস্ততঃ ছড়ানো নুন। দু’টো কাঁচালঙ্কা। (এ’গুলো সবুজ হতেই হবে। নইলে যজ্ঞ ভণ্ডুল।) আর একপাশে “সাইড প্লিজ” বলে পিছন ঠেকিয়ে রাখা আলুভাজা। মিনিট দশেকের মধ্যে জগৎ অন্ধকার।
ইবন এসে দেখল ইলতু মরে পড়ে রয়েছে। এক দু’টো মাছি ভনভন করছে মুখের কাছে। কষ বেয়ে একটু লালাও বেরিয়েছে। বিকেলের রোদ দেওয়াল থেকে নেমে এসে মেঝেতে লুটোপুটি খাটছে। এ’রকম অবেলায়…
আলুভাজার কড়াইটা ধুয়ে রাখা নেই। ধুতে হল। ঘুমভাঙানির ব্যবস্থা করতে হবে। উনুনে ভেজা কড়াই বসালেই হুশহুশ করে রেলইঞ্জিনের মত ধোঁয়া ছাড়ে। গরম কড়াইতে দু’কোয়া রসুন ফেলে পেঁয়াজ কাটতে বসল ইবন। রসুন পুড়ুক। পুড়ছে। তার চারপাশ দিয়ে এক ছিপি সর্ষের তেল ছড়িয়ে দেওয়া হল। তার উপর চাপানো হল এক ধামা মুড়ি। মুড়ি উষ্ণ হচ্ছে। রসুনগন্ধী তেল মাখছে। ইবন এমন করে লঙ্কা কুচোয়, মনে হয় সেগুলো দ্বিমাত্রিক। তৃতীয় ডাইমেনশন হারিয়েছে। ধামার মধ্যে রসুন মুড়ি এলো। তার উপর কুচোনো পেঁয়াজ, লঙ্কা, আচারের তেল, বিটনুন, একটু চিনি, একফালি নারকেল, আর… বাপিবিহারীর জঙ্গল থেকে প্রাণ হাতে করে উদ্ধার করে আনা চানাচুর।
ধামা নিয়ে খচরমচর করে ঘরে ঢুকতেই ধড়মড় করে উঠে বসল ইলতুৎমিশ। ইবনের মনে পড়ল, একদিন কোনও ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে ইলতু তাকে কানে কানে বলেছিল, “তোকে আমি ঝালমুড়ির থেকেও ভালোবাসি।” মনে হচ্ছে না কথাটা সত্যি।