বাইরে তুমুল বৃষ্টি পড়ছিল। ঘরে ঢোকা মাত্র থেমে গেছে। ছাতাটা বারান্দায় দরজার কাছে রাখা। জল ঝরতে, শুকোতে। এখন কার্নিশ থেকে টুপ টুপ করে জল পড়ছে তাতে। তালে তালে। আমি ডাক্তারদাদুর ঘরে বসে আছি। একটা কাঠের চেয়ারে নাইলনের কাজ করা। ঘরে কুকুর কুকুর আর স্পিরিট স্পিরিট গন্ধ। কুকুরটাকে বেঁধে রাখা আছে ভিতরে। আমি কুকুর ভয় পাই না। বাওয়ালকে পাই। বাওয়াল আমাকে দেখলেই দাঁত বের করে গরগর করে। অন্য কোনও কুকুর করে না। ওর কীসের এত শত্রুতা আমার সঙ্গে কে জানে। পলেস্তারা খসা দেওয়াল থেকে মা কালী অ্যা অ্যা করে জিভ বের করে আছে। আমাকেও বের করতে হয়েছিল একটু আগে। ডাক্তারদাদু জিভ বের করে দেখেছে, চোখের তলার পাতা টেনে নামিয়ে কতটা লাল পরীক্ষা করেছে, স্টেথো বুকে চেপে কাশতে বলেছে। এখন আরামকেদারায় হেলান দিয়ে বসে বেনারসী গঙ্গায় সাঁতার কাটার কথা বলছে। বাড়ি থেকে পালিয়ে বেনারস গিয়ে আখড়াবাজি, হিমালয় গিয়ে সাধুবাজি। গল্পগুলো আমার মুখস্থ। মুখস্থ, কারণ আমার প্রায়ই জ্বরটা, পেট ব্যথাটা লেগেই আছে। আমি গল্পে কান দিচ্ছি না, নিখিলবাবু সেতার টিউন করছেন, তবলা কে বাজাবেন জানিনা, মৃদু হাতুড়ির ঠুকঠুক। বাজনা শুরু হবার আগের এই কান মোলা, গাঁট্টা চাঁটি শুনতে কী যে ভালো লাগে! রেডিওটার উপর রাজ্যের আর শতাব্দীর ময়লা পড়েছে। ডাক্তারদাদুর গল্প গিয়ে একটু একটু করে কীভাবে হোমিওপ্যাথিতে হাতেখড়ি হ’ল, সেই দিকে এগোচ্ছে। আমি পাত্তা দিচ্ছি না। রান্নাঘর থেকে সুজির গন্ধ আসছে। মিষ্টি সুজি। খিদে পাচ্ছে। গোঁজ হয়ে বসে আছি। গোটা রোববার সকালটা মারা যাবে। দাদুর কাছে এলে আর রক্ষে নেই। তাও তো এখনও দক্ষিণেশ্বরের গল্প শুরু করেনি। বিছানার উপর একটা টাটকা শারদীয়া বর্তমান। তার প্রচ্ছদে মা সারদা। ডাক্তারদাদু শাক্ত। গোটা পরিবার শাক্ত। নিখিলবাবুর আলাপ শুরু হল। একটা কোমল রেখাব পেয়েছি। বোঝা যাচ্ছে না এখনও কোন রাগ। আমি এই খেলাটা খেলি নিজের সঙ্গে। রাগ চেনার খেলা। বুড়ো বকেই চলেছে। আর ছোট্ট চৌকো কাগজে সাদা গুঁড়ো আর সাদা গুলি মিশিয়ে, পাকিয়ে পুরিয়া বানাচ্ছে। বানিয়েই চলেছে। মন্থরগতিতে। গল্প আর পুরিয়া একসঙ্গে শেষ হবে। খিদে পাচ্ছে খুব। গায়ের তাপ বাড়ছে। অন্ততঃ আমার তাই মনে হচ্ছে।

বোধহয় খুব মন দিয়ে রাগ চেনার চেষ্টা করছিলাম, বুড়ো কখন গল্প থামিয়ে দিয়েছে, টের পাইনি। বহু চেষ্টাতে বুঝেছি মধ্যমটা কড়ি। একটা টিকটিকি মা কালীর পিছনে লুকিয়েছিল, সে বেরিয়ে আসতেই আমার সঙ্গে ডাক্তারদাদুর চোখাচখি হয়ে গেল। তখনই বুঝলাম বুড়ো গল্প থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম, বুড়ো অশোক কুমারের মত চশমাটা খুলে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? সর্বনাশ! আবার গোড়া থেকে শুরু করবে নাকি? অ্যা জিভ, চোখের পাতা, কাশি। বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম ফর্টি নাইনে। দাদু এগিয়ে এলো। কপালে, গালে হাত দিয়ে তাপ নিল। বুড়ো হলে কি মানুষ ছোট হয়ে যায়? বাইরের চামড়ার খোলসের আয়তন একই থাকে, ভিতরের মানুষটা শুকোতে থাকে, তাই অত্ত ভাঁজ হয়ে চামড়ায়। বুড়ো এবার মাথায় হাত রাখল। চুলে বিলি কাটল খানিক। ঝুপ করে কান্না পেয়ে গেল। আমি ভীষণ অবাক হলাম। ইয়ার্কি নাকি? কান্না পাবার মতো কী হয়েছে? যত জোরে চাপতে যাই, তত বেগে বেরোতে চায়। “কী হয়েছে দাদু?” মুখ খুললেই হুড়হুড় করে ফ্লাডগেট খুলে যাবে। আমি দাদুর দিকেই তাকাচ্ছি না। মা কালী মা কালী। টিকটিকিটা কই গেল? ভয় হচ্ছে। চোখে জল ভরে এসেছে। বুঝতে পারছি। বুড়োও দেখতে পাচ্ছে নিশ্চয়ই। কী লজ্জা! ষোল বছরের ধেড়ে ছেলে… দাদুর ছেলের বউ বিশাল বাঁচিয়ে দিল। দু’টো প্লেট নিয়ে ঢুকেছে। লুচি সুজি। কিসমিস দেওয়া। একটা শিশিবোতল ছড়ানো টেবিলের উপর রেখে অন্যটা আমার দিয়ে বাড়িয়ে দিল। জয়া কাকিমাও দেখেছে। বেগটা কমেছে একটু। কাকিমা বলল, “কীরে অ্যাই! কাঁদছিস কেন?” উত্তর দেওয়া যাবে না। একটা লুচি ছিঁড়ে সুজির পায়েস মাখিয়ে মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছি। কাকিমা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দাদুর দিকে তাকালো। আমি সব দেখছি। দাদু বলল, “ও কিছু না। ঠাণ্ডা লেগেছে। হাঁচছে রাবণের মত। ওইজন্য চোখে জল।” বলে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মারল। আশ্চর্য! কাকিমাও দেখতে পেয়েছে। হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। আমার কান লাল হচ্ছে।

বুড়ো আর আমি নীরবে লুচি সুজি শেষ করলাম। প্লেটটা নামিয়ে রাখতে যাচ্ছি, বুড়ো বলল, “তেজপাতাটা চেটে নে, বউ ফরসা হবে।” আমি খুব রেগে গিয়ে বললাম, “ফরসা বউ চাই না!” বুড়ো একটা ভীষণ গা জ্বালানো হাসি হেসে বলল, “তাই বুঝি?” আমি বুঝলাম ছড়িয়ে মাঠময়দান করেছি। বুড়োর মুখ থেকে হাসিটা যাচ্ছে না। আমি বললাম, “তুমি না ডাক্তার?” বুড়ো বলল, “ঠিক। এই নে খাম। সাত দিনের রসদ আছে। একুশটা পুরিয়া। দিনে তিনটে করে খাবি। সকালে দুপুরে রাত্রে খাবার পর। এবার বল তো, নাম কী?”
“তোমার ছুঁকছুঁকানি রোগ হয়েছে।”
“রোগ হয়েছে তো প্রেস্ক্রিপশন দে! ওষুধের নাম বল!”
“ইবন বতুতা। হয়েছে?”

আমি ডাক্তার দাদুর একুশ পুরিয়া ওষুধ আর নিখিল বাবুর এক পুরিয়া কল্যাণ নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।