তারপর হল কী, সাপটাকে পেঁচিয়ে নিল পাহাড়ের গায়ে। মন্দার পাহাড়। যে সে পাহাড় নয়। সেই সেবার মধুকৈতব বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল। জেলা কোর্টে দিনের পর দিন মামলা চলছে। বিষ্ণু হয়রান। হতচ্ছাড়া উকিলের পিছনে টাকা কম ঢালা হচ্ছে না। এ’দিকে মন্দার বাজার। একদিন ভাগলপুর স্টেশনে নেমে গোরুর গাড়ি করে বাড়ি ফিরছিল মধু। বিষ্ণু কিছু ছেলেপুলে নিয়ে এসে মন্দার পর্বতকে তুলে চাপিয়ে দিল মধুকৈতবের উপর। গোরুর গাড়ি সমেত। দশ হাজার বচ্ছরের মামলার নিষ্পত্তি। কেউ খুঁজেই পায়নি লাশ। ত্রেতা যুগে একদিন কিছু প্রত্নতাত্ত্বিকের দল সে গোরুর গাড়ির চাকা একটা খুঁজে পায়। খাজুরাহোর যাদুঘরে রাখা আছে। যাই হোক, মন্দারকে তুলে নিয়ে গেছিল সমুদ্রমন্থন করতে। নোনতা মাখন বেরিয়েছিল কিছু। হাঁড়িতে করে নিয়ে গিয়েছিল কৃষ্ণ।

তপোবনে ইবনদের বাড়ির বাগানে এক জোড়া মন্দার গাছ আছে। মাদার গাছ। বতুর ফাদার তাতে নিয়ম করে জল দেয়। অম্মা হাত নেড়ে ঠুমরী গান। আজকাল আর শব্দ আসে না তেমন, হাত আগের মতোই নড়ে। বাইরের লোকে জানেনা, মীরার ভজনের থেকেও বেশি মিষ্টি অম্মার রাই-কেষ্টার ঠুমরী। শুনলেই বড় খামাজ খামাজ হয়ে যায় মনটা। ইলতুৎমিশের নমাজ পড়ার বাঁধা সময় নেই। অম্মার খামাজ শুনলেই… জানো, তার চেয়েও ভালো নদেয়ের কেত্তন। পিদিম পিদিম সন্ধ্যে হয়ে এলে ইলতু এক ধামা ঝালমুড়ি নিয়ে নাটমন্দিরের ধুনোর গন্ধ শুঁকতে যায়। কীর্তন তো ফাউ। গোঁসাই ঠাকুরের আঙুল মাছির মতন নড়ে হারমোনিয়ামের চাবির উপর। পল্লবের হাত খোলে, করতালে। কর মানে হাত। করতাল হাততালিকেও বলা যায়। যায় না? ইলতু হাততালি দেয়। তাকে সবচেয়ে বেশি টানে দীঘল কালো যে ছেলেটা ওমাগো কী মিষ্টি কীর্তনিয়া বাঁশি বাজায়। গায় গোরু গোরু গন্ধ। কোথায় থাকে কী করে কে জানে। পিদিমে দেশলাই পড়লেই ঠিক জুটে যাবে।

রোদ রোদ বিকেলে বল পেটানোর নিয়ম। খেলা গড়ায়, খেলা গড়ায়, সুয্যি গড়ায় পাটে, বল গড়িয়ে বনের ঝোপে, আনতে গেলে… মাঠের একদিকে নাটু মল্লিকের দোকান, রাস্তার ওপাশে। একদিকে মন্দির। এক দিকে নদী। আর এক দিকে বন। আতপ চালের বন। জোনাকি জোনাকি ঝিঁ ঝিঁ বিকেল হলে খেলাও পাটে তুলতে হয়। নইলে বল হারালে খুঁজতে যাবে কে? হাতে কাদা পায়ে কাদা চশমায় কাদা সাইকেলে কাদা সব্বাই মাথায় মশার স্তম্ভ নিয়ে বাড়ি ফেরে। ইলতুর ফেরার মত বাড়ি কই? এই শ্যামলা সন্ধ্যেতে লুকোচুরি খেলা যায় ভালো। তারচেয়েও বিপদজনক খেলা হল ছোঁয়াছুঁয়ি। মারাত্মক খেলা। স্পর্শকাতর ক্রীড়া। মেয়েরা খেলে। আর ছোট ছেলেরা। ইলতু ছোট। কিন্তু ছোটে বাঁইবাঁই করে। আজ ইবন কুমীর হয়েছিল। ক্রোকোডাইল নয়। অ্যালিগেটর। ইলতু একটু অন্যমনস্ক হয়ে জলে নেমেছে কি নামেনি, অমনি ধরা পড়ে গেল। শরীর বেঁকিয়ে চুরিয়ে পালাচ্ছিল, কুমীর নাছোড়বান্দা। কী একটা প্যাঁচ কষে ধরাশায়ী করে চেপে বসল বুকের উপর। “আর করবি?” ইলতু ভেবে পেলো না সে কী করেছে। “আর পালাবি?” ইলতু শুধু পালাতেই জানে। আর তাছাড়া খেলার শর্ত অনুযায়ী…
“ছুঁয়ে তো দিয়েছ, এখন তো আমি…”
“ছুঁয়েছি তো। বেশ করেছি। তুই কী?”
“আমি কুমীর হবো না?”
“খুব কুমীর হবার সাধ হয়েছে না? বল! উত্তর দে! আর পালাবি?”
অসহায়ের মত মাথা নাড়ে ইলতুৎমিশ। তার পালাতে ইচ্ছে করছে না। চাপা পড়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। “দেখি তুই কোথায় পালাস!” ইবন ঝুঁকে এসে আচ্ছা করে চুমু খায় ইলতুর মুখে ঠোঁটে গালে কপালে চোখে। “এই আমার টেরিটরি মার্ক করে দিলুম। আমার লক্ষ্মণরেখা। এক পা বাইরে গেলে…”

মন্দার পর্বতের টাকের উপর বসে রাত্রি নামা দ্যাখে ইলতুৎমিশ। আয়ো কাঁহা সে ঘনশ্যাম? কোত্থেকে আসে ছেলেটা কে জানে। নাটু মল্লিক ঝাঁপ বন্ধ করার আগে বোতলের জল ছিটিয়েছে ধুলোয়। বাড়ি ফিরে গেছে লণ্ঠন হাতে। মন্দিরে একটা প্রদীপ জ্বলছে এখনও। মিটমিট করছে। ময়ূরাক্ষীর বুকে রঙ গোলার মত করে চাঁদের ছায়া পড়েছে। গরম কাল অনুযায়ী যথেষ্ট জল ময়ূরাক্ষীতে। ইবন পড়তে বসেছে, ইলতু জানে। যাবার আগে খুব করে কান মুলে দিয়ে গেছে। টনটন করছিল। হাত দিয়ে মনে হচ্ছিল খরগোশের মত লম্বা হয়ে গেছে। এখন ছোট হয়ে এসেছে আবার। মন্দার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমিও পালিয়েছিলাম। তীর্থ। তারপর আবার গেড়ে বসেছি এখানে।”
“তীর্থ? না ভূপর্যটন?”
“ওই হল।”
“ভূগোলে ছাপ্পান্ন পেয়েছিলে?”
“এক মারব!”
“গেড়ে বসেছ বলে তোমার নাম মন্দার বোস?”
“বড় বকিস তুই। বাড়ি যা না!”
“নেই।”
“আবার পালাবার মতলব করছিস? এই তো ভাগলবা হয়ে ভাগলপুরে এলি…”
ইলতুৎমিশ উত্তর দেয় না।
মন্দার বোস বলে, “আস্ত গেঁড়িগুগলি তুই একটা, তোর বাড়ি তোর বুকপকেটে একখানা চিঠি রেখে গেছে কুমীর ডাঙা খেলবার সময়। পড়তে বোস।”