একটা রাজকাহিনী চাঁদ উঠেছে। যারা জানে, তারা জানে, এ চাঁদ যেমন তেমন চাঁদ নয়। অর্ধেকটা ক্ষয়া। আসলে না, সিকি ক্ষয়া। কিন্তু আকারে রোজকার পূর্ণিমার থেকেও বড়। যারা জানে, তারা জানে। এ চাঁদ বেশিক্ষণ থাকে না। মাহেন্দ্রক্ষণ বলে একটা কথা আছে। আমি বলি মাহেন্দুক্ষণ। রাজকাহিনী চাঁদ লাল রঙের হয়। সময় পেরিয়ে গেলে ছোট, সাদা। আমি সিঁড়ি থেকে বসে দেখছি। মাহেন্দুর আলো রাস্তাবাতিকেও ম্লান করে দিচ্ছে। বিশ্বাস হচ্ছে না তো? একটা ছবি তুলেছি। আমার পায়ের কাছে একটা বেড়াল বসে আছে। বাদামি বেড়াল। থাবা চাটছে। আমরা দু’জন মিলে চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আছি। রাস্তাবাতিটা সহ্য হচ্ছে না। হাতের ইশারায় নিভিয়ে দিলাম। আমি অমন অনেককিছু পারি। একদিন দেখাবো। চাঁদটার এপাশ ওপাশ দিয়ে সাঁতার কেটে যাচ্ছে কয়েকটা মেঘ। এরাও রাজকাহিনীর মেঘ। এমন সময় আমার পাশে এসে বসলেন অবনী। না, বাড়ি আছো ঠাট্টাটা করব না। ইনি অন্য অবনী। অবন ঠাকুর। কপালে চন্দনের ফোঁটা। গা থেকেও চন্দন চন্দন গন্ধ বেরোচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ভালো আছো? অবন ঠাকুর উত্তর দিলেন না। আমি বললাম বুড়ো আঙলা, ভালো আছো? অবন ঠাকুর আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে, তোর বাপ বুড়ো। আর তুই কচি খোকা, বুড়ো আঙুল মুখে পুরে ঘুমোস। আমি হাসলাম। বললাম, রাগ করছ কেন? অবন ঠাকুর বললে, হৃদয় লেগেছিল গণেশ ঠাকুরের পিছনে, কেমন, আর তুই লাগছিস অবন ঠাকুরের পিছনে?
বেড়ালটা পা চেটে চলেছে। নিজের পা। থাবা। আমি বললাম, ইলতুৎমিশকে নিয়ে একটা গল্প লেখো না! অবন ঠাকুর বললে, ইল্লি, অত সোজা! আগে শুনে দেখি, লিখবার মতো কিনা! জানো অবন ঠাকুর, মা একবার ভুরু প্লাক করতে গেছিল পাড়ার পার্লারে। বিয়েবাড়ি ছিল মনে হয় কোনও। ছোট্ট ইলতু পায়ে পায়ে গিয়েছিল সঙ্গে। সেখানে তার আলাপ হয়েছিল ক্ষীরের পুতুলের সঙ্গে। তারপর থেকে কতরাত সে পাল্কিতে চেপে ঘুমুতে যেত। জানো অবন ঠাকুর, ইলতু কিন্তু রাজপুর সৈন্য। তার ভীষণ শখ হয়েছিল গায়েব হবার, কারণ গায়েবীকে খুব মনে ধরেছিল, তারপর বুঝল গায়েব হলে বোন পাতাতে হবে। তাই কাঠের তলোয়ার ঝুলিয়ে রাজপুত সৈন্য। পাঠানদের সঙ্গে তার হেব্বি বাওয়াল! তখন রোজ রোজ এ’রকম রাজকাহিনী চাঁদ উঠত। অবন ঠাকুর, তুমি বড় ভালো আঁকো। আমি পারিনা কেন?
সিঁড়িটা আঁধার হয়ে রয়েছে। বেড়ালটার চোখ দেখা যাচ্ছে শুধু। অবন ঠাকুর উঠে চলে গেছেন। শুধু চন্দন চন্দন গন্ধটা রয়ে গেছে। চাঁদটার ঠিক তলায় যে বাড়িটা, সে’খানে গান চলছে রেডিওয়। ফির ওহি রাত হ্যায়। রাতভোর স্বপ্ন ম্যারাথন। চাঁদটা আস্তে আস্তে উপরে উঠছে। রঙ ফিকে হয়ে আসছে। রাস্তাটায় জল থইথই করছে। নাকি দেখবার ভুল, কে জানে। একটা শুঁয়োপোকা নটে গাছের পাতা চিবুচ্ছে। তাকে দেখামাত্র বেড়ালটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল। পোকাটা হ্যাহ্যা করে হাসল। রাস্তা নদীটার পাড় দিয়ে নালকের মত দেখতে একজন কেউ হেঁটে যাচ্ছে। চাঁদের তলার বাড়ির রেডিওর গান বদলে গিয়েছে। পালাচ্ছে দিনরাত্রি, পালাচ্ছে বারোমাস। সাতটা মজা পুকুর আর তেরোটা নর্দমা পেরিয়ে পাশের পাড়ায় পালিয়ে এসেছি। বেপাড়ার বেড়ালটা পালিয়ে গেল। শুঁয়োপোকাটা বলল, সংবাদ এনেছি। কী সংবাদ? অবাকডাঙা আবার গোল্লায় গেছে। হরতনের বিবি ফের মাথা বিগড়ে যার তার গলা কেটে নিচ্ছে। পাগলা হারুকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জবরখাকির ঘুম ভেঙেছে। আমি বললাম, আর অ্যালিস? অ্যালিস তারা হয়ে, আকাশে। এখন উপায়? তোমাদের পাঁজি কী বলছে? চাঁদটার সাধারণ হয়ে ওঠার সময় এসেছে। প্রায়। আর একটু বাকি। একটু। একটা সাদা ধবধবে খরগোশ এসে পায়ের কাছে কুটুরকুটুর করছে। কখন উদয় হয়েছে, খেয়াল করিনি। গানটা জোরে হল কী করে? খরগোশ বলল, আমার কান অ্যান্টেনার মতো। সব স্টেশন ধরে। কুঝিকঝিক কুঝিকঝিক পালাচ্ছে ছেলেবেলা। গন্ধলেবুর বাস মিশছে চন্দনে। অবন কোথায় গেলে? কোথায় গেলে, ইবন? খরগোশ চোখ পাকিয়ে বলল, ইবন এখন আমার। আচ্ছা ছোট চুল হলে কি কেশবতী হওয়া যায়না? মেঘবরণ হতে নেই? কোন রাজ্যের নিয়ম?
বেড়ালটা ফিরে এসেছে। এসেই ধাওয়া করেছে খরগোশটাকে। ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে। আমি জানি দু’জনে মিলে এখন অবাকডাঙা তাসের দেশে চলে যাবে। আমিও পালাবো। একটা কোটালপুত্রের অপেক্ষা। অপেক্ষা কো গুলি মারো। আজই যাবো। সুখ পালাচ্ছে, দুখ পালাচ্ছে, কে কার কাছে এসে, ছায়া পালাচ্ছে, ছবি পালাচ্ছে, ছায়াছবির দেশে। কোথায় থামবে?
মাথা তুলে দেখি রাজকাহিনী চাঁদটা দৈনন্দিন অপটু হাতে বেলা রুটি হয়ে গেছে।