ঘোড়া ছুটলে টগবগ আওয়াজ হয় না। জল ফুটলে হয়। আপাততঃ তেজিয়ান একটা ঘোড়া ক্ষুরে ধুলো উড়িয়ে ছুটছে। অমানুষরা অন্ধকারে ভালো দেখতে পায়। তাদের আলো লাগে না। তাই এই মহাকালীর অমাবস্যাতেও হোঁচট খাচ্ছে না ঘোড়াটা। তার পিঠের সওয়ারিরা ভীষণ রকম চুপ। রাস্তার বাঁ দিক ঘেঁষে খাড়াই পাহাড় উঠেছে। আর ডানদিকে মাটি পাথর ঢালু হয়ে মিশে গেছে সমুদ্রে। সমুদ্র বেশি নীচে নয়। খাদসম নয়। চার মানুষ হবে বড়জোর। চার ইলতুৎমিশ। পাঁচ ইবন বতুতা। এই সবই ভাবছিল ইলতুৎমিশ। চার আমি ইজুকাল্টু পাঁচ ও। তাহলে ও আমার পাঁচ ভাগের চার ভাগ। ইবন সামনে বসেছে। পিছনে ঢাল হয়ে ইলতুৎমিশ। আরও অনেক পিছনে পাপছাতি দস্যুরা ধাওয়া করেছে।
“তুতিকোরিন আর কদ্দূর রে?” ইবন শুধোয়। তার মাথায় ইলতুৎমিশের দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
“অনেক দূর। তার আগেই ধরে ফেলবে ওরা।”
“তাহলে?”
“তাহলে আর কী। চল আকাশ দেখি।”
ইলতুৎ শিস দেয়। ঘোড়াটা থতমত খেয়ে থেমে যায়। নাক দিয়ে হ্রেষাধ্বনি ছেড়ে বলে, সিরিয়াসলি? প্রাণে ভয় টয় নেই নাকি? ইবনেরও বোধহয় একই প্রশ্ন ছিল, কিন্তু সে মুখ খোলে না। দু’জনে নিঃশব্দে নামে ঘোড়ার পিঠ থেকে। ইলতুৎমিশ বলে, এবার তুমি এসো। ঘোড়াটা দুলকি চালে এগিয়ে যেতে যেতে বলে, যেমন তোমার মর্জি। মহাকালী অমাবস্যার রাতে দুই মূর্তি ঢাল বেয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠে এসে বসে। “একটুও মেঘ নেই, দেখেছিস?” সত্যি ই নেই মেঘ। এক কণা আলোও নেই। শুধু ছাদজোড়া কোটি কোটি জোনাকি ঝিকমিক করছে।
“ওই যে! সপ্তর্ষি! এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত!” ইলতুৎমিশের গলায় বালখিল্য উত্তেজনা। “ওই এক চিনে রেখেছিস তুই। পার্ক সার্কাসের ক্লাউন তুই একটা।” তারপর উত্তরপশ্চিম কোণে আঙুল দেখিয়ে বলে, “ও’টা কোন তারামণ্ডল বল তো?” ইলতুৎমিশ বিড়লা বলতে গিয়েও বলে না। নিজের রসিকতায় নিজেরই হাসি পেয়ে যায় তার। অন্ধকারে তা দৃষ্টিগোচর হয়না বতুতার। তাছাড়া তার চোখ উত্তরপশ্চিম কোণে। “ওটা তুঁতে নক্ষত্রমণ্ডলী। দি ইন্ডিগো কন্সটেলেশন।” ইলতুৎমিশ চিনতে পারে। নামমাত্র ঢেউ সমুদ্রতে। অথচ বেশ ফুরফুরে ওজোনদার হাওয়া। প্রায় স্থির আয়নাতে তারাগুলো প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। এত উজ্জ্বল! দিগন্ত ঠাহর করা যাচ্ছে না। কালোয় কালোয় মিশে গেছে। আচ্ছা, এত যে ফসফরাস থাকার কথা নোনা জলে, তার কী হল? ঢেউ নেই বলে শব্দ ও নেই। শুধু কিছু ইতস্ততঃ ছলাৎ।ইলতুৎমিশের পাতলুনের তলাটা ভিজছে।
“আমাদের কী হবে রে?”
“কী আবার হবে। মরে যাবো। তুঁতে পুঞ্জে আরও দু’টো নক্ষত্র যোগ হবে।”
“ভাল্লাগেনা কিন্তু ইলতু। আমরা তুতিকোরিনের দিকে না গিয়ে থামলাম কেন?”
“না থামলে এত সুন্দর আকাশ দেখতে পেতি?”
দু’জনে আবার আকাশের দিকে তাকায়। উত্তর পূর্বে একটা তারা বড় বেশি উজ্জ্বল। “ও’টা খালি বড় হচ্ছে না রে? এগিয়ে আসছে কেমন দেখ! নিশ্চয়ই ধূমকেতু বা উল্কা!” একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকলে বাস্তবিক মনে হয় তারাটা এগোচ্ছে। বড় হচ্ছে। কিন্তু খানিক পরে, অন্যদিকে তাকিয়ে ফের তার দিকে তাকালে বোঝা যায় যে কে সেই। দৃষ্টিভ্রম। “ও’টা তুই।” ইলতুৎমিশ বলে। “ও’টা বুদ্ধির বৃহস্পতি।” দুম করে একটা কিল এর শব্দ হয়। তারাটাকে দেখলে এগোয়। না দেখলে এগোয় না। অবজারভেশন চেঞ্জেস দি ইভেন্ট। শ্রডিঞ্জারের কোয়ান্টাম তারা। আলো যদি সত্যিই সুতো হবে, টানলে আসে না কেন?
“ইলতু। ভয় করছে।”
“আমারও।”
“তা হলে হাঁ করে তারা গিলছিস কেন?”
“উফ! মরার আগে একটা ভালো জিনিস দেখে যেতে চাই। এমনিও মরব, ওমনিও মরব।”
“ওরা মেরে ফেলবে, নারে?”
“ইয়েস। ওরা আরাবল্লীর দস্যু নয়। পাপছাতিচা’র দস্যু। ওরা খচাং করে না। ঘ্যাচাং করে।”
“ওদের এত ইয়ে কীসের রে? ওদের কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি আমরা?”
“প্রশ্নটাও সহজ। আর উত্তর ও তো জানা।”
“ওরা ডেমেন্টর। মানুষের সুখ শুষে নেয়। তারপর ছিবড়ে করে ফেলে দেয়।”
“সবই তো জানো বতু। ওদের থেকে পালানো যায় না। হয় সুখ বিসর্জন দাও, নইলে…”
“নইলে সুখ বিসর্জন দাও। এই তো?”
“ইয়েস। আমরা এখন বিজয়া চতুর্দশীতে তুতলান্তিকে সুখ বিসর্জন দিতে এসেছি।”
“ওই।”
“বলে।”
“আমার একটুও দুঃখ লাগছে না।”
“আমারও না।”
“তাহলে ছাই বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে।”
“হচ্ছে না তো।”
“তাহলে?”
“তাহলে আপদগুলো এলে যুদ্ধু করতে হবে, দু’টি সুখী প্রাণী ভার্সেস কিছু মিজারেব্ল ফুল। কে জিতবে মনে হয়?”
“জানিনা।”
“আমিও না। কিন্তু পালিয়ে বেড়ানোর থেকে ঢের ভালো। টেক এ স্যাড সং, অ্যান্ড মেক ইট বেটার।”
“ইলতু। ওই তারাটা সত্যিই বড় হচ্ছে রে।”
“বাজে কথা বলিস না।”
“মাইরি। দেখ। লেজ অবধি আছে।”
“হ্যাঁ। গায়ে ছত্রাক ও আছে। আশ্চর্য উল্কা!”
“এক মারব। ভালো করে দেখ। তুঁতে পুঞ্জের কাছে। ও’টা উল্কা নয় ইলতু। ও’টা ধূমকেতু!”
“ধূমকেতু এলে ভূমিকম্প হয়।”
“বন্যা হয়।”
“মহামারী হয়।”
“দাবানল টল ও হয় বোধহয়।”
“প্রেম হয়। শিওর। এই দ্যাখ! গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।”
“ইলতু।”
“বলে।”
“ওদের জিততে দেবো না। কেমন?”