বাজির দোকান বলে কিছু হয় না। যেমন আবির-রঙ-পিচকিরির দোকান বলে কিছু হয় না। কালীপুজোর আগে মুদির দোকানও বাজি রাখে, চায়ের দোকান ও বাজি রাখে। ধোপা-ইস্তিরির দোকান ও বাজি রাখে। ওরা কি নিজেদের মধ্যে বাজি রাখে, কার কত বাজি বিক্রি হবে? দোলের আগেও তেমনি সবাই চৌকি পেতে আবির বিছিয়ে বসে। দুর্গাপুজোর আগে সবার সামনেই খেলনা বন্দুক ঝোলে। আমি স্বপ্নে দেখলাম টুকাইকাকুর দোকান থেকে বাজি কিনছি। টুকাইকাকু এমনিতে চাল আর তেল বিক্রি করে। একটা ছোট্ট ঘুপচি ঘর ভর্তি বস্তা। কিন্তু বাইরে রোয়াক। সন্ধ্যেবেলা ভরপুর আড্ডা বসে সে’খানে। উল্টোদিকে মন্টুর চায়ের গুমটি। মিস্ত্রিপাড়ার দোকানিদের ভরসায় সে গুমটি টিকে আছে। টুকাইকাকুর দোহারা চেয়ারা। মাথায় স্বল্পবয়সী টাক, কিন্তু স্বাস্থ্য ভালো। ছিপিছিপে। বাবা বলে ও রোজ সকালে শান্তিনগরের মাঠে দৌড়তে যায়। আর কেউ খেলতে নিলে ফুটবল খেলে। টুকাইকাকু আমার থেকে ভালো জানত আমি কোন চাল নেবো। কতটা নেবো। আমার চালের নাম মুখস্থ থাকে না। আর দাম ও হেরফের হয় প্রতি মাসে। গতমাসে বেয়াল্লিশ টাকার চালটা নিয়েছি, সেই চালের দাম এই মাসে দেখা গেল কমে হয়েছে চল্লিশ টাকা পঁচাত্তর। আবার বাড়বে। আমি গিয়ে শুধু বলি “আমরা যে চালটা নিই।” অনেক সময় কিছু বলতেই হয় না। আমি গিয়ে দাঁড়ালে বলে ব্যাগ দাও। আমি দু’টো পাটের থলে ধরিয়ে দিই। টুকাইকাকু ইয়াব্বড় দাঁড়িপাল্লায় একটা টিনের জারিকেনে চাল মেপে থলে তে ঢেলে দেয়। আমি থলে ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। থাকতাম। একটা থলে হলে চলবে না। যত কমই চাল নিই, এক থলে হলে সাইকেলের একদিক বেশি ভারী হয়ে যাবে। চালাতে পারব না। তাই দুই থলে। সামঞ্জস্য। চাল আনতে বাবার সাইকেল নিয়ে যেতাম। স্বপ্নে দেখলাম চালের বস্তার উপর চড়াই বসে। খুঁটে চাল খাচ্ছে। ঘটনা সত্যি। সত্যিই চাল খেত চড়াই। টুকাইকাকু ঢুকলে ফুরুৎ করে কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেত। আমাদের কারুর মাথাব্যথা ছিল না তাই নিয়ে। যাইহোক, রোয়াকের সামনে চৌকি বিছিয়ে বাজিগুলোকে রোদ দেখাচ্ছে টুকাইকাকু। চারপাশে সবাই বাজি বিক্রি করছে। আমি টুকাইকাকুর থেকেই কেন নিচ্ছি, জানিনা। স্বপ্ননির্মাতা জানেন।
আসলে জানি। এখন বুঝতে পারছি। কালীপুজোর বাজিও আমি কখনও কিনিনি। বাবা যা এনে দিত, তাইই। আমি শব্দবাজি ফাটাতাম না। মায়ের ভয় ছিল খুব। এমনি বাজিও খুব বেশি না। ঠাকুর্দার শ্বাসকষ্ট ছিল। কিছু তারাবাতি আর রংমশাল আর তুবড়ি আর চরকি কিনে আনত বাবা। আর বাদবাকি পাড়ার যা সবার আছে, তাতেই দিব্যি হয়ে যেত। টুকাইকাকু আমাকে দেখেই থলেতে বাজি পুরতে শুরু করল। ও সব জানে। আমাকে বাছতে হল না। তাই ওকেই দেখেছি। টুকাই কাকুর পাশের দোকানটা কিশোরী কাকুর লন্ড্রি। আশির দশকের চুল জুলপি গোঁফ ওলা একটা লোক। এখন মনে হচ্ছে কিশোরীকাকুকে পুরো ফ্রেডি মার্কারির মতো দেখতে। ওইরকম দাঁত উঁচু। ওই চোয়াল। যখন বাড়ি ছেড়েছি, তখনও ক্যুইন শোনা শুরু করিনি। কিশোরীকাকুর পাশের দোকান শঙ্করকাকুর। শঙ্করকাকু আমার প্রাণের বন্ধু। কারণ শঙ্করকাকুর রোলের দোকান। রোল চাউমিন মোগলাই পরোটা। ভেজিটেবিল চপ। সরু একটা বেঞ্চি। তাকের উপর একটা তেলচিটে রেডিও। তাতে কমেন্টারি। ও ও মোহনবাগান। ও ও খোঁচা দিলে দাদাকে খিস্তি করত, আর বাদ যাবার পর মনমরা হয়ে থাকত। স্বপ্নে দেখলাম ওর দোকানটা উঠে গেছে। স্বপ্নেই হেবি মনখারাপ হল। বিকেলে বাবা বাড়ি ফেরবার আগে কতবার লুকিয়ে একটা ডাবল চাউমিন নিয়ে গেছি বাড়ি। একটা কাগজের প্যাকেটে দু’টো আড়াআড়ি গার্ডার। আর ফোকর দিয়ে এক-দু’টো চাউমিনের সুতো বেরিয়ে আছে। মাঝেমধ্যে মনে হত টুকাইকাকু বাবাকে বলে না দেয়। ও বাবার বন্ধু। শঙ্করকাকু আমার। বলে নি কখনও। দেশ ছাড়ার আগে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী আনব। শঙ্করকাকু বলেছিল ওখানকার সিগারেট এনো। আমি একটা লাল মার্লবোরো নিয়ে গেছিলাম প্রথমবার ফেরার সময়। কিছুক্ষণ মন দিয়ে প্যাকেটটা পড়ল। মেড ইন ভার্জিনিয়া। তারপর আমায় জড়িয়ে কেঁদেই দিল। আমি মনে রেখেছি ও নাকি ভাবতেই পারেনি। ও নাকি নিজেই ভুলে গেছিল। আমি যখন ছবি তোলা শুরু করি, বাবার কোডাক কেবি১০ এ, প্রথমদিককার একটা ছবি ছিল শঙ্করকাকুর। ওর বিশাল তাওয়ায় তেলে ডুবডুব পরোটা ভাজছে এগরোলের জন্য। ছবিটা প্রিন্ট করে ওকে একটা কপি দিয়েছিলাম। ও দোকানে রেখে দিয়েছে।
গুগল স্ট্রিট যেমন করে ৩৬০ ডিগ্রী ক্যামেরা ঘুরিয়ে রাস্তার ছবি দেখায়, (মিস্ত্রিপাড়া দেখায় না। অত অবধি চোখ পৌঁছয়নি ব্যাটাচ্ছেলের), আমি স্বপ্নে ওইভাবে পাড়াটা দেখছিলাম। অগ্রণী ক্লাব। দাস ইলেকট্রনিক্স। তার সামনে একটা পিছন খোলা টিভি রাখা, আজ অবধি সারানো হল না। একটু এগিয়ে ফেলুর মিষ্টির দোকান। আর উল্টো দিকে এগোলে মিস্ত্রিপাড়ার মসজিদ। আমাদের বাড়ি চিনতে গেলে প্রথম ল্যান্ডমার্ক। তার উল্টো দিকে সুকুর সাইকেলের দোকান। সুকুর কথা অনেক লিখেছি একসময়। নিজেকে সুকুর অ্যাসিস্টেন্ট মনে হত। সুকুকে সুকুকাকু বা নিদেনপক্ষে সুকুদা বলা উচিৎ আমার। বলি না। কেন কে জানে। সুকু একটা ময়লা গামলায় জল ভরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সাইকেলের টিউব চোবাচ্ছে, আর আমি অপেক্ষা করছি কখন বুড়বুড়ি কাটবে। তবে গিয়ে ফুটো বোঝা যাবে। তারপর তাপ্পি।
হাওয়াই চটি হাফপ্যান্ট চশমা সেই আমিটা কোথায়? হঠাৎ কালীপুজোর বাজি-বাজার কেন দেখলাম স্বপ্নে? স্মৃতির চরিত্রগুলো এক জায়গায় করে একটা নতুন দৃশ্য বানিয়েছে স্বপ্নেশ্বর। টুকাইকাকু মোটেই বাজি বিক্রি করে না। শঙ্কর, কিশোরী কেউই না। তাহলে? জানি না। শুধু জানি ওদের মত স্বপ্নের প্রোটাগনিস্ট সেই হাফপ্যান্ট হাওয়াই চটি চশমাও একটা চরিত্র। আমি নই।