ইউলিসিস জাহাজের একেবারে সামনেটায় দাঁড়িয়ে আছে। ভোর ভোর ভাবটা কেটে গিয়ে সকাল হচ্ছে আস্তে আস্তে। সমুদ্রের উপর মিহি কুয়াশা। গতকাল রাত অবধি মাঝিমাল্লাদের ব্যস্ততার অন্ত ছিল না। আজ ভোরে দূরে দিগন্তে ইথাকার বন্দর দেখতে পাবার পর সবারই গা ছেড়ে দিয়েছে। প্রেক্ষাপট না জানলে দর্শক ভাববেন তারা হতোদ্যম হয়ে পড়েছে। কিন্তু ঘটনা তা নয়। ইথাকা যে সত্যিই পৌঁছনো যাবে, সে’টা সদ্য উপলব্ধি করছে তারা। দীর্ঘ একটা দশক তারা বাড়ির বাইরে। যতজন রওনা হয়েছিল, তার অর্ধেকও হয়ত এই জাহাজে নেই। যারা আছে, তারা ধরেই রেখেছিল ফিরবে না। ট্রয়ই জীবন। সমুদ্রই জীবন। এক-দু’বছর বাদে আর বাড়ির জন্য মনকেমনও করত না। অভ্যাস। মানিয়ে নেওয়া। মানুষ যখন বোঝে অতি কাঙ্খিত কিছু কোনওভাবেই পাওয়া সম্ভব নয়, তখন পাবার আশা ছেড়ে দেয়। আশা জিইয়ে রাখলে কষ্ট বেশি। তাই এই ওডিসি ও তাদের কাছে আর একটা অভিযান বই কিছু ছিল না। আজ ইথাকার বন্দর দেখে তারা একটা অদ্ভুত জটিল যুদ্ধের মধ্যে পড়েছে। যুদ্ধটা নিজের মনের সঙ্গে। একদিন যে ইথাকার বন্দর তাদের দিনরাত তাড়া করে বেড়াত, নিজের অজান্তেই তাকে মূল্যহীন করে দিয়েছিল সবাই। একবার কোনওকিছু দাম হারালে, তারপর হাতের নাগালে এসে গেলে কেমন লাগে? হিসেব অনুযায়ী ইথাকা দেখতে পাবার সঙ্গে সঙ্গে খুশিতে আবেগে উছলে ওঠার কথা সবার। কিন্তু তা হচ্ছে না। একটা শহর শুধু বাড়ি তো নয়, প্রিয়জনও। তাদের সবার মুখ মনে পড়ছে। দশ বছর আগে দেখে আসা মুখ। এতদিনে তারা বড় হয়েছে, বুড়ো হয়েছে। বাড়িটাও কি আগের মতো আছে? সামনের রাস্তাটা? মধ্য ইথাকার পেল্লায় বাজারটা? বাজারের বাইরেই দুর্গন্ধময় খাটালটা আরও দূরে সরিয়ে দেবার কথা হচ্ছিল, সরে গেছে নিশ্চয়ই এতদিনে। আর রাজপ্রাসাদটা? ইউলিসিস মহাশূন্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার দৃষ্টি ইথাকা ভেদ করে আরও ওপারে চলে যাচ্ছে। ইথাকা যেন স্বচ্ছ। দেশের মানুষ এক দশকের অনুপস্থিতিতে ধরে নিয়েছে রাজা মৃত। মাঝিমাল্লাদের ক্ষেত্রেও কি তাই? সমুদ্রে ঢেউ তোলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ালো ইউলিসিস। বলল, “জাহাজের মুখ ঘোরাও। ইথাকা যাচ্ছি না আমরা।” মানুষের ভুল ভাঙানোর প্রয়োজন নেই। আদেশ শুনে মুহূর্তে আবার ব্যস্ত হয়ে উঠল গোটা জাহাজ। সবার ভিতরের কঠিন প্রশ্নটার সমাধান করে দিয়েছে রাজা ইউলিসিস। ক্যাপ্টেন ইউলিসিস। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে কি করছে না, সে’টা এখন অকিঞ্চিৎকর একটা প্রশ্ন। করছে যে না, ইথাকা যে এখন আর তাদের বাড়ি নয়, এই অপ্রিয় সত্যটার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। রাজ-আদেশ। মানতে হবে। হেঁইয়ো।
রঞ্জন হাঁ করে বালির উপর দাঁড়িয়ে আছে। সে তার বন্ধুদের সঙ্গে টিলার উপর খেলছিল। টিলাটা উত্তরদিক থেকে উঠতে উঠতে হঠাৎ সমতল হয়ে গেছে। খানিকটা তার সমতলত্ব বজায় রেখে তারপর আচমকাই শেষ হয়ে গেছে। খাদের মতো। নীচে বালি। আর সমুদ্র। চড়াই থেকে দেখলে মনে হবে এখানেই পৃথিবীর শেষ। বর্ষাকালে, বা শীতকালে খুব কুয়াশা হয় টিলার নীচে। তখন বালি বা সমুদ্র দেখাই যায়না। মনে হয় খাদটা অতল। কিন্তু আদপেই বেশি উঁচু নয় টিলাটা। লাফ দিয়ে বালিতে নামলে বড়জোর গোড়ালি মচকাতে পারে। রঞ্জন লাফ দিয়েই নেমেছে। সুঁড়িপথ দিয়ে উঠে যাবে। বল নিয়ে। বল ফেলেছে সে-ই। কুড়িয়ে আনার দায়িত্বও তারই। গরম বালিতে খালি পা তেতে যাচ্ছে, রঞ্জনের ভ্রূক্ষেপ নেই। সে হাঁ করে তট থেকে একটু দূরে দাঁড়ানো জাহাজটা দেখছে। গলা ছেড়ে বন্ধুদের ডাকতেও ভুলে গেছে রঞ্জন। আগেও একদিন এ’রকম একটা জাহাজ দেখেছিল সে। কিন্তু মাথা ফেরাতে ফেরাতে অদৃশ্য হয়ে গেছিল সে’টা। অতবড় জাহাজ কী করে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়, তা বোধগম্য হয়নি এগারো বছরের ছেলেটার। কেউ বিশ্বাস করেনি তার কথা। আজ মাথা ফেরাতে পারছে না রঞ্জন। যদি আবার হাপিশ হয়ে যায়?
রঞ্জনদের মফস্বলী গ্রামে কোনও বন্দর নেই। মূল শহর থেকে বেশ একটু পূর্বে তাদের এই গ্রাম। শহর থেকে টিলা, সমুদ্র দেখতে লোক আসে। ঘুরতে। আনন্দ করতে। গ্রামের লোক শহরে যায় কাজে। রঞ্জনের এখনও শহরে যাওয়া হয়নি। শহরের বন্দর থেকে ছাড়া বিশাল জাহাজগুলোকে ডিঙি নৌকার মত ছোট হয়ে দিগন্ত দিয়ে ভেসে যেতে দেখেছে। কিন্তু এই জাহাজটা একেবারে নাগালে। এবং তাকে ডাকছে। রঞ্জন, আসবে না? রঞ্জন, যাবে না বাড়ি? ঘোরের মধ্যেই শিউরে উঠল রঞ্জন। বিড়বিড় করে বলল, আমার বাড়ি তো শিমুলতলায়। জাহাজটা বলল, সত্যি? রঞ্জন জবাব দিতে পারল না। জাহাজ বলল, তোমার মা থাকেন তোমার বাড়িতে? রঞ্জনের চোখে জল চলে এলো। সে মাথা নাড়ল। তার মাকে চোখেই দেখেনি সে। জাহাজ আবার প্রশ্ন করল। তোমার বাবা কোথায় রঞ্জন? রঞ্জন কান্না আটকাতে পারছে না। এক বছরের শিশুকে গ্রামের লোকের কাছে দিয়ে বাবা দেশ ছেড়ে ছিলেন। শিবুদাদু বলেন, তোমার বাবা সমুদ্রে ঘর পেতেছে, বুঝলে ছোঁড়া, তোমার যা গতিক দেখছি, তুমিও সাগরেই বিছানা পাতলে বলে। মিনুমাসি হেসে বলেছিল, কী যে বলো, রঞ্জন আমাদের বিছানাতেই সাগর পাতে। রঞ্জন লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল। এ’সব কথা এখন মনে পড়ছে কেন? জাহাজের ডেকে একটা লোককে দেখা যাচ্ছে। সেও মনে হয় দেখতে পেয়েছে রঞ্জনকে। রঞ্জনের পা নড়ছে না। জাহাজটা একটা গম্ভীর ভোঁ দিল। রঞ্জন পরিষ্কার শুনতে পেল, জাহাজটা বলছে, বাড়ি যাবে না, রঞ্জন? বাবার কাছে যাবে না? লোকটার অবয়ব দেখা যাচ্ছে শুধু। সিল্যুয়েটেড বাই দি সী। কার যেন গানটা?
এক পাল এগারো বারো বছর বয়সী ছেলে টিলার উপরে দাঁড়িয়ে দেখল রঞ্জন জল কেটে, আধা সাঁতরিয়ে একটা বিশাল জাহাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
(ছবিঃ ক্লদ মঁনে)