আজকে পুজো। কালকেও হতে পারে। টের পাওয়া মুশকিল। কয়েদে থেকে কিছুই টের পাওয়া মুশকিল। পুজো করাই যায়। তেমন কঠিন কিছু না। মন্ত্রের শব্দ ভুল না হলেও হল। মন্ত্রের বইও কয়েদখানায় আছে। মন্ত্র পড়লে ঠাকুর এমনিই আসবে। ঠাকুরকে বিসর্জন দিতে হয় না। দিতে নেই। খোয়াই এর কাছে গিয়ে বলতে হয়, ঠাকুর, থেকো, কেমন? কয়েদ বড় সুন্দর। অসহ্য সুন্দর। ফাটক নেই, গারদ নেই। কিন্তু পালিয়ে যাবার উপায় নেই। একজোড়া চোখ সর্বক্ষণ নজর রাখছে। ইবন একটা গল্প বলেছিল ইলতুকে। একটা কয়েদখানার গল্প। সেপাইরা বন্ধ ঘরের ছিদ্রের মধ্যে থেকে কয়েদিদের পাহারা দেয়। সেপাই কয়েদিদের দেখতে পায়, কয়দিরা সেপাইদের দেখতে পায় না। সেপাইরা থাকতেও পারে। নাও থাকতে পারে। শ্রডিঞ্জারের সেপাই। কয়েদিরা ধরে নেয় রয়েছে। কেউ না কেউ রয়েছে। এই কয়েদখানার জেলার সদা উপস্থিত। মূর্ত। ইবন বতুতার চুল ছোট। পিছনের বারান্দা দিয়ে নামিয়ে দেবে আর রাজপুত্তুর টুক করে উঠে আসবে, সে উপায় নেই। কড়া নিয়ম। এ’দিক ও’দিক হবার জো নেই। হুকুম, সুখে থাকতে হবে। দুঃখে থাকা চলবে না। মন খারাপ করলে শাস্তি। এ’রকম হুকুম শুনলেই মন খারাপ হয়ে যায় ইবনের। শেষ বিকেলের, আর দুপুরবেলা খেয়ে ওঠার পরের মন খারাপটুকু তো ভালো লাগে। কাছের মনে হয়। পোষা। আচ্ছা মন খারাপ করলে মানুষ কী করে? ইবন চুপ করে বসে থাকে। চুপ করে। কথা বলতে ইচ্ছে করে না। পা ঠাণ্ডা, নাক ঠাণ্ডা। মন খারাপ একটা পাকানো ছায়ার মতো ঘিরে ধরে সমস্ত ওম শুষে নেয়। কিন্তু মন খারাপ করা চলবে না। কথা বলতে হবে অনর্গল। কথা শুনতে হবে, উত্তর দিতে হবে। ইলতু বলে মন খারাপ হলে মাধ্যাকর্ষণের বল বেড়ে যায়। সত্যিই যায়। উঠে বসতে লড়াই করতে হয়। উঠে দাঁড়াতে হলে মনে হয় শরীর চৌচির হয়ে যাবে। পা চলে না। হাত চলে না। কিন্তু জেলারের হুকুম। চা বানাও। দুধ চা। এলাচ। সিনেমা দ্যাখো। ইচ্ছে করছে না করছে না করছে না। দু’টো ধুমসো লোক মারামারি করছে দেখতে ইচ্ছে করছে না। হুকুম ইজ হুকুম। নড়াচড়ার জো নেই। দেখতে হবে। হাসির জায়গায় হাসতে হবে। ভালোবাসতে হবে।

পড়ন্ত বৈশাখে এত ঠাণ্ডা কেন? ইলতুৎমিশ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। উড়িয়ে হাওয়া দিচ্ছে। ঘুরপাক খাচ্ছে। মেঘ নেই বলে ঝড় বলে ডাকা যাচ্ছে না। স্টর্ম নয়। উইন্ড। লিলুয়া বাতাস নয় কোনওভাবেই। সাঁত্‌রাগাছি বাতাস। একটা কানা তোবড়ানো থালার মত চাঁদ উঠেছে। রাস্তার ওপারে ধোপঘর। ধোপযন্ত্র। পরিধান প্রক্ষালন যন্ত্র। সে’খানে আলো জ্বলছে। একটা মেয়ে এক গামলা ময়লা কাপড় নিয়ে গেছে ধোবে বলে। জানলা দিয়ে সব দেখা যাচ্ছে। একটু নাক টেনে শুঁকলে সাবানের গন্ধও পাওয়া যায়। মেয়েটা যন্ত্রের হাঁ এর মধ্যে জামাকাপড় ঢেলে দিল। তারপর পরণের জামাটা খুলে ফেলল। কয়েক সেকেন্ড কী ভেবে সে’টাও ঢুকিয়ে দিল ভিতরে। তারপর বৈশাখের অকাল শীতে আদুর গায়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। পাশের গলি দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। মিলিয়ে যাবার পর ইলতুৎমিশ বুঝতে পারল মেয়েটা বতু। তা সম্ভব নয়। কিন্তু সম্ভব হয়েছে। আজ বা কাল পুজো। পুজোর সময় এ’রকম হয়ে থাকে। চাদর জড়ানো জড়সড় ইলতু ঘরে ঢুকে এসে পুজো করতে বসল। উতল আঁচল, এলোথেলো চুল দেখেছি, ঝড়েরও বেলা, গোপনে দেখেছি।

কয়েদখানায় সাক্ষাৎপ্রার্থীদের আসার অনুমোদন আছে। সপ্তাহে তিনবার। তিনের জায়গায় চার হয়ে গেলে জেলারের মুখ ভার হয়ে যায়। দুই হলে ইবনের। শাস্তি। সেই সাক্ষাৎ ও নজরঘেরা। কয়েদিদের ছাড় দিতে নেই। ইবনের সঙ্গে দেখা করতে কেউ আসে না। শুধু ইলতু আসে। জেলারের জন্য নজরানা নিয়ে। এক ফ্লাস্ক চা’পাতার রস। এক টিন তামাককাঠি। দৈবাৎ চা বেশি ফুটে গেলে বা তামাক বেশি কড়া হয়ে গেলে বা রান্নায় ঝাল না থাকলে ভ্রূ দ্বিতীয় ব্র্যাকেট হয়ে যায়। ইলতু আসে ইলতুলগ্নে। সেই লগ্নে আসে বলেই ইলতুলগ্ন নাম, নাকি ওই সময়ের রোদ ইলতুর হেলিপ্যাড কপাল আর ডাকাতিয়া চুলে পড়ে প্রতিফলন প্রতিসরণ খ্যালে বলে, তা নিয়ে আভিধানিক বৈয়াকরণদের মধ্যে দ্বিমত আছে। অগা লোকে একে কনে দেখা আলো বলে। ইলতু কি কনে? অন্য সময়ে ইলতুৎমিশকে আইরিশ জেলেদের মতো অপরিষ্কার লাগে। গা থেকে মেছো গন্ধ বেরোয়। ইলতুলগ্নে ইলতুৎমিশ কেমন মৌরী মৌরী হয়ে থাকে। খিড়কির বাইরে বাগানসিঁড়িতে বসে তারা আলাপ করে। এই বাগানটা দেখলে ইলতুর ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগানের কথা মনে পড়ে। সে ঠিক করেছে পাইনহাটার সাতটা আশ্চর্য বের করবে। এক হচ্ছে পাইনপাহাড়ের তলায় গোরস্থানে বিগত সম্রাট হুমায়ূনের সন্তানের কবর। মুঘলসরাই এর হুমায়ূন তার খোকা আকবরের প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন ঠাকুরের কাছে। ঠাকুরের বোধহয় ডীলটা পছন্দ হয়েছিল। পাইনহাটার হুমায়ূন সে সুযোগ পাননি। তিনি পোকামাকড় নিয়ে শোনাপড়া করতেন। কী অদ্ভুতভাবে কোনও এক অজানা পোকার কামড়ে তার ছেলেটির মৃত্যু হয়। কবরের উপর একটা শ্বেতপাথরের বাচ্চার মূর্তি। তার মাথা নেই। ছিল, চুরি গেছে, না ছিলই না, জানা নেই। অনেক কাল আগের কথা। সেই বাচ্চার হাতে একটা থালা। থালার মধ্যে একটা টিকটিকি। টিকটিকিরও মাথা নেই। এই গেল এক। দুই হল বতুর ঝুলন্ত বাগান। “এই তুলসীপাতাগুলো আলো পাচ্ছে না বলে আলো খেতে হইহই করে বাড়ছে, দ্যাখ! কোই মিল গ্যয়ার জাদুর মতো।” অনর্থক কিছু কথা। ঠিক মতো তাকাতে পারে না সে ইলতুর দিকে। ভয়। গোড়ালি পেঁচিয়ে মনখারাপের গাছ লতিয়ে উঠছে। ইলতু কখনও কখনও সেই পরগাছা মারার ওষুধ নিয়ে আসে। যে ওষুধ ধনেপাতা গাছের সার, সেই ওষুধই মনখারাপ গাছের বিষ। যার বোঝার বুঝেছে। কিন্তু ওই। লুকিয়ে। চোরাচালান।

আজ বুদ্ধপূর্ণিমা। আজ থালাটার তোবড়ানো দিকটা সোজা হয়ে যাবে। এখনই কতো আলো। রোদের মতো। ঠাণ্ডা রোদ। ছায়া পড়ছে। কাল পুজো। লুম্বিনীর ঠাকুর। শিলাইদহের ঠাকুর। একটা উজ্জ্বল থালাবাটির দিকে তাকিয়ে একজন কয়েদি আর একজন কোনও কাজের না রাজা মন্ত্র পড়ছে।

তোমাতে আমাতে হয় নি যে কথা,
মর্মে আমার আছে সে বারতা,
না বলা বাণীর নিয়ে আকুলতা,
আমার বাঁশিটি বাজানো।