ইলতুৎমিশ মুখ চুন করে বসে আছে। সে তার এগারো বছরের ক্ষুদ্র জীবনের সবচেয়ে মারাত্মক ভুলটা করেছে। খাটের উপর পড়ার জলচৌকিটা রাখা। তার একটা পা ছোট। ইলতুৎমিশের মতই। ইলতুর বাঁ পা টা ডান পায়ের থেকে সামান্য বড়। চোখে দেখে বোঝা যায় না। কিন্তু হাঁটার সময় সে টের পায়। কাউকে বললে কেউ বিশ্বাস করে না। কিন্তু ইলতু জানে। তা বাঁহাতের পাঞ্জাও ডান হাতের থেকে বড়ো। আপাতত জলচৌকির উপর একটা সদ্য খয়েরি মলাট দেওয়া বাংলা সাহিত্যের বই। বইটা স্কুলের পাঠ্য। স্কুল খোলার আগেই সবক’টা গল্প পড়া হয়ে গেছে ইলতুর। ইংরেজি বইটার গল্প গুলোও। মলাটের উপর সাঁটা লেবেল। শেষ লেবেল, আর নেই। লেবেলে ইলতুৎমিশের নামের বানান ভুল। জলচৌকির ওপার থেকে বাবা একবার তার দিকে তাকাচ্ছেন, একবার নামের দিকে। ইলতু দ্রবণ হয়ে যেতে চাইছে, গুলে মিশে যেতে চাইছে। কিন্তু হাওয়ায় মানুষের শরীর গোলে না। এর আগে এ’রকম ঘটনা আর একবার ঘটেছিল। যদিও এত মারাত্মক নয়। ইলতুৎমিশের তখন ষোল বছর বয়স। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হবে। ফর্ম নিয়ে এসেছে বাড়িতে। প্রথম নাম। পারিবারিক নাম। অনেকগুলো করে খোপ। ইলতুৎমিশ প্রথম নামের জায়গাতেই সবটা লিখে ফেলেছে। ইলতুৎমিশ মহালানবিশ। বি অবধি লেখা হয়েছে। আই এস এইচ লেখার জায়গা নেই। তখনই সে খেয়াল করেছে পারিবারিক নামের জন্য আলাদা জায়গা ছিল। এখন কাটাকাটি করতে হবে। এই দুই ঘটনার আরেকটা মিল, দুইবারই বাবা বসেছিলেন সামনে।

বাবার সামনে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যায় ইলতুর। যে কাজ সে বাঁহাতে এক চোখ বন্ধ করে পিটপিট করতে করতে করে ফেলতে পারবে, বাবা সামনে থাকলে তুতলিয়ে একশেষ। গতসপ্তাহে শনিবারে দুপুরের খাওয়া হয়ে যাবার পর বাবা শশা কাটতে বসেছিলেন। খোসা ছাড়িয়ে চাকা চাকা করে কাটা হয়েছিল শশা। ইলতু খোশা ফ্রিজে ঢুকিয়ে শশা ফেলে দিয়েছিল ময়লার বালতিতে। আজ সে নিজের নামের বানান ভুল করেছে। ক্লাস ফাইভে পড়ার অধিকার কি তার আছে? যে ছেলে নিজের নামের বানান ঠিক করে লিখতে পারে না, সে সিঁড়িভাঙা অঙ্ক করবে? ইলতু সিঁড়িভাঙা অঙ্ক করতে পারে। নির্ভুল। সে মাধ্যমিকে অঙ্কে, এবং অ্যাডিশনাল অঙ্কে একশো পেয়েছে। স্কুল থেকে উপহার স্বরূপ টাকা দিয়েছিল কিছু। তাই দিয়েই ব্যাঙ্কের হাতেখড়ি হবার কথা ছিল। সে’সব ষোল বছরের কথা। এখন তার এগারো বছর বয়স। সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে ন’বছর বয়সে অঙ্ক রেসে সবার আগে কঠিন ভাগের অঙ্কটা করে সবার আগে দৌড়ে শেষে পৌঁছেও বাতিল হয়ে যাচ্ছে। অঙ্কটার সবক’টা ধাপ সে দেখায়নি। মনে মনে হিসেব করে উত্তর লিখে ফেলেছে। নিয়মে তেমন ছিল না। কেন? কেন? কেন? ইলতুৎমিশের চোখ ফেটে জল আসছে।

ইলতুৎমিশ যখন বড় ছিল, এমনটা হত না। হত, ভুল সবারই হয়, কিন্তু কুঁকড়ে যেত না। বাবা মা আসবেন তার কাছে, ঊনিশ রকম টিকিট কাটতে হয়েছে। তার আগে পাসপোর্ট, ভিসা করিয়ে দিতে হয়েছে। বিমানের টিকিট ই এগারো রকম। কত জায়গায় ঘুরতে যাবার। সে নিজেই তখনও থিতু হয়ে উঠতে পারেনি। ঊনিশের মধ্যে একটা ভুল হয়েছে। যে জায়গায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল সে, তারই টিকিট কেটেছে, কিন্তু একমাস পরের। মনে মনে হতাশ মুখ কল্পনা করে নিয়েছে সে, তারপর টোটো কোম্পানির মোড়লের সঙ্গে রফা করেছে। আমার টাকা ফেরত চাই না। ওই জায়গায় না-ই গেলাম, তার বদলে এখন কোথায় নিয়ে যেতে পারবে বলো। ব্যবস্থা হয়েছে। বাবা মায়ের কাছে সব জায়গাই নতুন। সবই সুন্দর। তাঁরা হতাশ হননি। বড়ো থাকতে আরও ভুল করেছে। কিন্তু বুঝেছে সবাই ভুল করে। বাবাও। ভুল আটকানো যায়না। খুব সচেনতন থেকেও। শুধরোনো সম্ভব। ভুলবশতঃ তৈরী হওয়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও সম্ভব। বাবা সে কাজ ভালো পারেন। শেষ কুড়ির ইলতুৎমিশ ও তাতে পারদর্শী।

কিন্তু এখন ইলতু ছোট। ছোট্ট। ভীতু। ভুলো। আবার ছড়িয়েছে সে। ভিতরের ঘরের কোণায় হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। ইবন রাগ করেছে খুব। খুব? আর আসবে না? আসবে না। রাগ হবারই কথা। নিজের হাতে জলচৌকি বানানোর পর থেকে যাওয়া কাঠের বাড়তি টুকরো থেকে পেন্সিল ছুরি দিয়ে কেটে কেটে একটা পুতুল বানিয়ে দিয়েছিল সে ইবনকে। তার মনে সে ইবনকেই বানানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ইবন যখন সে’টা দেখে বলল, “হেব্বি হয়েছে তো কাকতাড়ুয়াটা!” তখন সে আর মুখ খোলেনি। হঠাৎ গতকাল কাকতাড়ুয়াটা চেয়ে বসেছে ইলতু। ছাদে রাখবে। লোকে দেখবে। কাকে দেখবে। ভুল করেছে। কাউকে ভালোবেসে দেওয়া জিনিস কখনও চাইতে আছে? ইবন রাগ করেনি। কষ্ট পেয়েছে। রাগ আর কষ্টের তফাৎ ইলতু জানত, আজ বুঝল।

এমন সময় বাইরের জানালায় ছায়া পড়ল। ইলতু তাকিয়ে দেখল – ইবন। এসেছে! হাতে পায়ে আঠা। “আর করবি না এ’রকম।” ঘাড়টা যতখানি হেলানো যায়, ততখানি হেলালো ইলতুৎমিশ। তারপর ছুট লাগালো দরজার দিকে।

অসমান পায়ে দৌড়তে গিয়ে ধপাস করে আছাড় খেল সে।

*****

ছবিঃ কাকতাড়ুয়া ও কৃষক, নাফিস।