গাছ দু’ধরণের। বন্য, ও গৃহপালিত। গৃহপালিত গাছের সবচেয়ে ভালো সার কী জানো? চিঠি। গাছের তলায় পুঁতে রাখতে হয়। রাত হলে যত্ন করে লেখা চিঠি অনেকগুলো ভাঁজ করে খামে পুরবে। জিভে অল্প থুতু এনে অ্যা অ্যা করে চেটে খামের মুখ বন্ধ করবে। জিভে আঠার স্বাদ লেগে থাকবে অল্প। আমাদের ছোটবেলার খামে এ’রকম আঠা থাকত না। আঠাকাঠিও পাওয়া যেত না তখন। একটা মোটা প্লাস্টিকের কৌটো হত, তাতে থাকত গলা আঠা। কৌটোর যে ঢাকনি, তার সঙ্গেই লাগানো থাকতো ছোট্ট একটা বুরুশ। সেই বুরুশ এ করে আঠা মাখানো হত চিঠিতে। ডাকটিকিটের পিছনে। গাছের সারের জন্য কিন্তু ডাকটিকিট ওলা খামের প্রয়োজন নেই। এমনি খাম। কার প্রতি, ঠিকানা, প্রযত্নে, কিচ্ছু লেখা থাকবে না। শুধু নম্বর। কত নম্বর চিঠি, সেইটা। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে গাছের গোড়ায় চিঠিখাম পুঁতে আসতে হবে। সকালে উঠে দেখবে নেই নেই। গাছ সে চিঠি খেয়ে ফেলেছে। বেশ একটু বড়ও হয়েছে। কোনও কোনওদিন চিঠি রাখতে গিয়ে দেখবে আগে থেকেই একটা চিঠি পোঁতা আছে। তখন খুব সাবধানে সেই পাল্টা চিঠি বের করে নিজের চিঠি পুঁতে আসতে হবে। এই হল নিয়ম। প্রাচীনকালের নিয়ম, আমি বানাইনি।

ইলতুৎমিশ বেরিয়ে পড়েছে। তার পরণে একটা খাটো ধুতি, পাম্প শ্যু। একটা মাফলার পাওয়া গেছে। সে’টা মাথায় ফেট্টির মতন করে বাঁধা। গায়ে একটা খয়েরি হাতকাটা ফতুয়া। চাষা চাষা দেখাচ্ছে কি? কে জানে। ইলতুৎমিশের কাঁধে একটা মেজো লম্বা লাঠি। লাঠির আগায় একটা থলে বাঁধা। গামছার থলে। বাড়িতে অনেক খাবার ছিলো বেরোনর সময়। পাঁউরুটি। ম্যাগি। বাসি ভাত। চারটে ডিম। কিন্তু বেরিয়ে পড়ার নিয়ম হচ্ছে শুধু চিঁড়ে আর গুড় নিতে হবে। ইলতুৎমিশ তাই ঝোলায় কেবল গুড় চিঁড়ে নিয়েছে। আচ্ছা এইরকম ঝোলাতে করে গুড় নিয়ে যেত বলেই কি ঝোলাগুড় বলত? কে জানে। এ’টা পাটালিগুড়। নাকি চিটেগুড়? পাটালিই হবে। একটা ভুল হয়ে গেছে। চিঁড়ে নিলে জল নিতে হয়। এ’টা উহ্য, তাই প্রবাদে বলা নেই। কিন্তু ইলতুৎমিশ জল আনতে ভুলে গেছে। একটা গলায় ঝোলানো বোতল আনা উচিৎ ছিলো। বাবা সবসময় বলত, জলের বোতল নিয়ে বেরো। একটা বোতল নিয়ে বেরোতে কী হয়? এখন জলের ব্যবস্থা কী হবে? ইলতুৎমিশ ভাবতে ভাবতে হাঁটছে। এই জাতীয় পথিক প্রথমে ক্ষেতের ধার দিয়ে হাঁটবে, আলপথ দিয়ে, বটগাছের তলায় ছায়ায় জিরোবে, পুকুর থেকে একটি সুন্দরী মেয়ে নেয়ে উঠে কলসী কাঁখে দুলতে দুলতে যাবে, ফিরে তাকানো বারণ, সে মেয়ের দিকে তাকানোও বারণ। তারপর সেই পুকুরের জলে হাতমুখ ধুয়ে চিঁড়ের পোটলা খুলে বসবে। ইলতুৎমিশ ক্ষেত পায়নি। পাবে কোথায়? ভুট্টা ক্ষেত যা আছে, সে অনেক দূর। অনেকদূরই অবশ্য তার যাবার কথা। “চলেই যাবো” বলে বেরোলে কাছাকাছি যাওয়া সাজে না। বার্লিনে যাবো বলে বটতলা থেকে ফিরে এলে হবে? ঠাম্মা এ’রকম করে। স্বপ্নে। স্বপ্নেই হেঁটে হেঁটে নাতির কাছে আসবে ভাবে, তারপর খেজুরহাটে গিয়ে রাস্তা ভুলে যায়, তারপর একটা পুলিশওলা তাকে পৌঁছে দিয়ে যায় বাড়ি। সে যাই হোক। ক্ষেত বটগাছ পুকুর পেরিয়ে গ্রামের শেষে ঘন জঙ্গল, শেয়াল ভালুক মহুয়া। বাঘ টাঘ নেই। ভূত ও না। ভূত জনবসতিতে থাকে। জঙ্গলে ভূত গিয়ে কী করবে? জোনাকি থাকে। ঝিঁঝিঁ। সাপ। সরু পায়েচলা রাস্তা। মধ্যে একটা বাড়ি। খবরদার সেখানে যেও না। ক্লান্ত অবসন্ন শরীর ঘুম চাইবে। জঙ্গল আর শেষ হচ্ছে না। একটা গাছে ডালে উঠে ঘুমোতে হবে। কোনও গল্পই এই জঙ্গলের পরে কী আছে বলে না। রেললাইন? পরের গ্রাম? গল্পগুলোও মানুষের মতো। জঙ্গলে যে যায় আর ফেরে না। ইলতুৎমিশ ও ফিরবে না।

ইলতুৎমিশ এত সব ভেবেই চলেছে। কতটুকুই বা হেঁটেছে? এখনও ঘাড় ঘোরালে নিজের বাড়ি দেখা যাবে। ঘাড় ঘোরালো। দেখা যাচ্ছে না। সে কোথাও-যায়-না সিঁড়ি পেরিয়েছে, রেলের মাঠ পেরিয়েছে, পাইন পাহাড় পেরিয়েছে, সওগাহাচির ঝিল পেরিয়েছে। ইশ, সে’খান থেকে জল নিয়ে নিলে হত। কীসে নেবে জল? বোতল নেই তো। জলের কথা ভাবলেই তেষ্টা পায়। সওগাহাচির ঝিলে কুমীর আসে, জানো? কেউ কখনও দেখেনি। কিন্তু আসে। সওগাহাচি ঝোরা আছে, ঝিল থেকে বেরিয়ে টালাসি নদীতে পড়ে। সেই নদী দক্ষিণে মেক্সিকো উপসাগরে মেশে। সেখান থেকেই কুমীর আসে। আসত আগে। খাল কেটে কুমীর আনার ব্যবস্থা। ইলতুৎমিশ উত্তরে যাচ্ছে। দক্ষিণে নয়। আরও অনেক অনেক অনেকক্ষণ হাঁটলে ধোঁয়াপাহাড়। সেদিকে যেতে ইচ্ছে করছে না। সেখানে ইলতুৎমিশ গেছে আগে। অবশ্য কোথায় যাবে সে’টা আগে থেকে ঠিক করা মানা। হয় তিব্বত যেতে হবে, নয়ত যে’দিকে দু’চোখ যায়। আপাতত দু’চোখ বতুর বাড়ির দিকে যাচ্ছে। চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। না। না। শোনো, যে রাস্তা ধরেছ, তাই দিয়ে সোওজা চলো। সে রাস্তা শেষ হলে ডাইনে বাঁয়ে কোনও একদিকে ঘুরো। তারপর সেই রাস্তার শেষ অবধ হাঁটো। জর্জ হ্যারিসন বলেছেন, কোথায় যাবে যদি জানা না থাকে, যে কোনও রাস্তা তোমায় সেখানে পৌঁছে দেবে।

আলো যখন একেবারে নিভে এলো, ইলতুৎমিশ খেয়াল করল, সে অবার্নপুরের প্রান্তে তেঁতুলবনের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তাটা হুট করে শেষ হয়ে গেছে। মৃত অন্ত। ডানদিকবাঁদিক বলে কিছু নেই। কিচ্ছুটি নেই। একটা ফুটফুটে জোছ্না‌ হয়ে রয়েছে। জোছ্না‌ বললেই পূর্ণিমা মনে হয় কেন? পুরো গোল একটা টোপলা চাঁদ না হলে বুঝি জোছ্‌না হতে নেই? আজ এক ফালি নখের মতো চাঁদ। তাতেও দিব্যি জোছ্না‌। এতটাই, যে চাঁদের বাকি অনুজ্জ্বল অংশটুকুও বোঝা যাচ্ছে। নখটা বতুর হাতের মতো। জোছ্‌নার কোনও ইংরেজি নেই কেন? মুনলাইট। সানলাইট। জোছ্‌না। রোদ্দুর। বাংলা ভাষাটা কী ভালো! রাস্তার উপর বাবু হয়ে বসল ইলতুৎমিশ। ঝোলা খুলল। চিঁড়ে গুড় খেতে ইচ্ছে করছে না। ঝোলায় আরেকটা জিনিস আছে। একটা চিঠি। সে’টা মিশ পড়েনি। রাগ করে পড়েনি। যে রাগ করে বেরিয়ে এসেছে, সেই রাগ করেই পড়েনি।

প্রিয় ইলতু, চিঠি বলছে, বতুর গলা করে। প্রিয় ইলতু, জঙ্গলে ঢুকিসনা কেমন? আমি জানি তুই তেঁতুলবনে ঢুকবার আগেই চিঠি পড়বি। আমি জানি। বতুরা সব জানে। জঙ্গলে যাস্‌ না ইলতু, ওখানে গেলে যে আর কেউ ফেরে না। তুই না ফিরলে আমার কী হবে রে? আমি ধনেপাতাগাছের সার হয়ে যাবো। তুই তাই চাস্‌, বল? তেঁতুলবলে পথিকের দেবীরা থাকে। অপদেবী, ঠাম্মা বলেছে। একটা হানাবাড়ি, আর অপদেবতা। ইলতু, এখন কোনও আলো নেই, না রে? তুই জোছ্‌নায় আমার চিঠি পড়ছিস। অ্যাই ইলতু, তুই এত সুন্দর কেন রে? সামনাসামনি সুন্দর লাগে না। পাশ থেকে লাগে। একদিন তোর চশমা খুলে নিয়ে পালিয়ে যাবো। কোনও কাজের না ও’টা। দেখতেই পাস না তুই আমায়, ওই চশমায় লাভ কী? শোন। শোননা। যে’খানে খুশি যা। যে’দিকে দু’চোখ যায়। কিন্তু বলে যাস্‌, কেমন? ইতি, ইবন বতুতা।

দু’চোখ বতুর বাড়ির দিকে যাচ্ছে। বেশ রাত করে ধনেপাতা গাছে সার দিতে বসল ইলতুৎমিশ। নরম করে টবের তলায় সাদা খাম নীল কাগজ চিঠিটা রেখে এলো। “বাজে বতু, ভাবিসনা তোর জন্য ফিরলাম। জলের বোতল আনতে ভুলে গেছি। ওইজন্য ফিরেছি। শুকনো চিঁড়ে মানুষে খেতে পারে? কাল আমার জন্য স্যান্ডউইচ বানিয়ে দিবি? ঝোলায় পুরে আমি বিবাগী হবো। ইতি।”