আশি মাইল মানে কত কিলোমিটার? ইন্টারস্টেট পঁচাশিতে একটা অংশ আমার খুব প্রিয়। মাইল একান্ন থেকে মাইল আটতিরিশ। ভীষণ রকম একা রাগ দুঃখ ভয় হতাশা লজ্জা একসঙ্গে চেপে বসলে আমি গাড়ি নিয়ে বেরোই। ওই অংশটা খুব ফাঁকা থাকে। দু চারটে পাঞ্জাব লরি, সাত আটটা এমনি গাড়ি। নিমেষে পুটকি হয়ে যায়। আমি একটা দেড় ঘন্টার বন্দিশের শেষের ঝালার মতো এগোই। কাচ নামিয়ে। বাতাস আমার তরফদারী করে। আমি পাশ কাটানোর সময় অকারণে খুব খিস্তি করি অন্য গাড়িদের। খুব বাজে বাজে কথা বলি। নোংরা অশ্রাব্য কথা। ওরা শুনতে পায় না। না পাওয়াই ভালো। ওদের সঙ্গে আমার কোনও শত্রুতা নেই। কাকে গালি দিই কে জানে? কিন্তু দিই। সুখ হয়। তারপর আটতিরিশের একজিট নিয়ে ধীরে সুস্থে বাধ্য লক্ষ্মী ছেলের মতো গতিমাত্রা মেনে বাড়ি ফিরি। একশো মাইল মানে একশো ষাট কিলোমিটার। কতদিন যাইনি।

এখন খুব ঝড় হচ্ছে। আবহাওয়া দপ্তর বলছে আশি মাইল প্রতি ঘন্টা। আমাকে ছুঁতে পারেনি। এখনও না। শিলাবৃষ্টি হতে পারে। টেনিস বলের সাইজের শিলা। গাড়িটা চুরমার হবে তাহলে। এখন আমি বারান্দা থেকে দেখতে পাচ্ছি মীরাবাঈ শান্ত খুকিটি হয়ে পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে আছে। তার সারা গায়ে বৃষ্টির ছিটে। ছাদে একটা টোল। কী করে হয়েছে কে জানে। আমি জানি মীরাবাঈ এর বুক গরম হয়ে আছে। বৃষ্টির ফোঁটা বনেটের উপর পড়লেই ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে। মীরা, লোভ হচ্ছে যে খুব। মীরাবাঈকে যেখানে দাঁড় করানো, তার সামনেই রেলিঙ। ওপারে অন্য অ্যাপার্টমেন্ট। রেলিঙের গায়ে যমজ ঝোপ। সেই ঝোপে এক পাখি দম্পতি বাসা বেঁধেছে। বাচ্চা হয়েছে। এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না। চিঁচিঁ আওয়াজ করে। সেই আওয়াজ শুনেই আবিষ্কার করেছি। নইলে চোখেও পড়ত না। কাছে গিয়ে দেখেছি। একটা না, দু’টো ছানা। হলুদ মুখ গুলো আমায় দেখলেই হাঁ করছে। বতু বলবে হ্যাংলা। ও পাখি বিশারদ। আমি অগা। মা পাখিটা বাসার ভিতর। রাগ রাগ চোখ করে তাকিয়েছে আমার দিকে। বাবা পাখিটা খাবার আনতে গেছে। বাসাটার কিছু হবে না তো? ওরা বুদ্ধি করে খাসা জায়গা বেছেছে। ঝোপটা শক্ত। নরম পাতা নয়, কঠিন কাঁটা পাতা। মোটা। ভারী। ঝড়ে সহজে এলোমেলো হবে না। কিছু হবে না বলো বাসাটার? কালকেও শুনতে পাবো চিঁচিঁ। বলো না! সেই যে সেই আগন্তুক পাখিটাকে নিয়ে এসেছিলাম শেলবির বাইরে থেকে? ওই যে গো, যার রাণীক্ষেত হয়েছিল, বলেছিলাম না? ওর জন্য কিছু পাখির খাবার রাখা আছে। কাল ঝড় থামলে সেগুলো বাটি করে বাইরে রেখে দেবো, মাকালীর দিব্যি। আজ ওদের কিচ্ছু হবে না।

আকাশটা লাল হয়ে আছে। অদ্ভুত একটা আলো। ফরসা হয়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তেইশ সেকেন্ড পরে আওয়াজ আসছে। তখন আমার কাঠের মেঝে থরথর করে কাঁপছে। বতু একটা বাদামী বিড়াল। বতু খুব ঝড় ভয় পায়। আমি পাইনা। ওগো আমি তুফান পেলে বাঁচি, আমি ডুবতে রাজি আছি। বতু একটা গুটলি পাকিয়ে আমার পা পেট বুক মাথা বৃত্তের ভিতর শুয়ে আছে। ঘন ঘন লেজ নাড়ছে। সেই মখমলি লেজ আমার মুখে এসে পড়ছে। বাজ পড়লে কেঁপে কেঁপে উঠছে। ভয় পেয়ো না বতু। আমি আছি তো।

আমি আছি। মীরাবাঈ আছে। ইন্টারস্টেট পঁচাশি আছে। তার উপর পরিত্যক্ত সেতু আছে। অম্বুজা সিমেন্টের চেয়েও শক্তিধর ঝোপ আছে। তাতে বাসা আছে। বাসায় মা বাবা ছানা এক ছানা দুই আছে। তাদের নাম দেওয়া হয়নি। বাড়ির পিছনে রেললাইন আছে। বুকের উপর দিয়ে যাওয়া মালগাড়ি আছে। দেখতে দেখতে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসবে। দেখো!