বেলপুকুরের মিশ পরিবারের ছেলেদের একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। জিনজ ব্যাপার। তারা সাতাশ বছর বয়েসে জন্মায়। মানে সাতাশ বছর বয়সে হঠাৎ উদয় হয়। তারপর এমন ভাব করে সকলে, যেন এতদিন তারা এখানেই ছিল। ছোটবেলার সমস্ত স্মৃতির থলে শুদ্ধু তারা উদয় হয়। যখন জন্মায়, তাদের খুব কুচ্ছিত দেখতে হয়। যত বয়স বাড়ে, তাদের দেখতে ভালো হতে থাকে। বয়স কমে, এমন না। কিন্তু দাঁড়কাকের মতো চেহারার ছেলেদের গায়ে গত্তি হয়, আরশোলা চাটা গালে সুন্দর দাড়ি গজায়। এক মাথা চুল। চোখে মায়া। পুরু ঠোঁট। তারপর তারা একদিন টুক করে মরে যায়। কেউ রোগে ভোগে না। শয্যাশায়ী হয় না। এমনিই মরে যায়। অনাড়ম্বর। এত মায়াবী সুন্দর শব কেউ কখনও দ্যাখেনি।

ইলতুৎমিশ কে দেখতে সুন্দর হয়েছে। হোৎকা কোলাব্যাঙ থেকে মানুষ মানুষ চেহারা। একমাথা উটপাখির বাসার মতো চুলেও তাকে দেখতে সুন্দর লাগে। দাড়ি কামালে রূঢ় লাগে বটে, বয়স কমে, কিন্তু তবুও সুন্দর লাগে। স্নান করলে ভদ্র লাগে, স্নান না করলে দার্শনিক মনে হয়। তার চেহারায় উগ্রতা নেই। মানে তাকে দেখলে ফিল্মস্টারের মতো আকর্ষণীয় লাগে না, আকর্ষণীয়, অথচ ধরাছোঁয়ার বাইরে। তেমন নয়। তাকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। আপন মনে হয়। গলগল করে কথা বেরিয়ে আসে। ইলতুৎমিশ এবার হুট করে মরে যাবে। যে কোনওদিন। ইলতুৎমিশ চায়ে বিস্কুট ডোবালো। বিস্কুটটা ডুবে গেল। ইলতুৎমিশের রাগ হল খুব। কেন ডুববে ও? ওর বাবা মা ওকে সাঁতার শেখায়নি? রাগের চোটে সে আরও তিনটে বিস্কুটকে ডুবিয়ে মারল। তারপর গুলে গোটা জিনিসটা খেলো। খারাপ লাগছে না। ঘনত্ব বেড়েছে। পথ্যের মতো খেতে লাগছে। বাইরে মেঘগুলো চুপকি দিচ্ছে। চুপকি দেওয়া শব্দটা অনেকদিন পরে মাথায় এলো ইলতুতের। ছোটবেলায় গলিতে ক্রিকেট খেলার সময় চুপকি দেওয়া মানা ছিল। তিনচারবার বল করার ভান করে বল না করা। তারপর হুট করে বল করে দেওয়া। ব্যাট্‌সম্যান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভুল্ভাল শট খেলত। বা খেলতই না। মেঘগুলো ও’রকম করছে। বৃষ্টি নামবে নামবে করছে, কিন্তু নামছে। সে বাইরে বেরোলেই দু’চার ফোঁটা, ভিতরে ঢুকলেই আবার বন্ধ। চায়ের কাপের তলায় গলা গলা একটা না-তরল না-কঠিন প্রলেপ। ইলতুতের মেজাজটাও ওইরকম হয়ে রয়েছে। না রাগ, না কষ্ট। দু’টোই। শ্রডিঞ্জারের মেজাজ।

মিশ পরিবার ক্রীতদাসের পরিবার ছিল। বেলপুকুরের সম্রাটের ক্রীতদাস। সে সময় গিয়েছে। ইলতুৎ বেলপুকুর ছেড়ে এসেছে। সে এখন পাইনহাটার রাজা। রাজা ব্যাপারটা অদ্ভুত। তার কোনও প্রজা নেই। তার অস্তিত্বই কেউ জানেনা। কেউ খাজনা দেয় না। কিন্তু সবাই জানে, রাজা একজন আছে। তাকে পাত্তা না দিলেও চলে। রাজা পদটাই বিস্মৃতপ্রায়। তার এই গোপন পরিচয় আর তিনজন মাত্র জানে। পাপহরকরার যুবরাণী ইবন বতুতা। সূত্রধর কল্লোল। আর উড়ে এসে জুড়ে বসা স্যমন্তক। ইলতুতের প্রবল সন্দেহ স্যমন্তক রাজা হতে চায়। কেন চায় সে’টা কঠিন ব্যাপার। পাইনহাটার রাজা হবার কোনও বাড়তি সুযোগ সুবিধে নেই। একমাত্র কারণ হতে পারে ইবন। পাইনহাটার রাজার সঙ্গে তার বিয়ে হবার কথা। গল্প হচ্ছে, ইলতুৎ ভাবে, ইবন কী চায়? পাইনহাটার রাজাকে চায়? না ইলতুৎকে চায়? রাজত্ব ছেড়ে দিতে ইলতুতের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু রাজত্ব তাকে ছাড়বে না। সে যতদিন রাজা, ততদিন পাইনহাটা আছে। সে পদত্যাগ করলে এ’টা অন্য শহর হয়ে যাবে। কেউ টের পাবে না। কিন্তু হবে। ইবনকে ছেড়ে দিতে ইলতুতের প্রবল আপত্তি আছে। বিশেষতঃ স্যমন্তকের হাতে। সমস্যা একটাই। ইলতুৎমিশ যে কোনও দিন মরে যেতে পারে।

এই আছি-বৃষ্টি নেই-বৃষ্টি ঘটনাটা ভালো লাগছে না। শ্রডিঞ্জারের বাক্স খুলে দেখতে হবে বিড়ালটা জীবিত না মৃত। অবজার্ভেশন চেঞ্জেস দি ইন্সিডেন্ট। ইলতুৎমিশের তার চেয়ে বেশি ক্ষমতা। সে পরিণতিগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু স্থির করতেই তার সময় কেটে যায়। এ’টা, না ও’টা? তারপর সে অদৃষ্টের হাতেই ছেড়ে দেয় সব। আজ দিলো না। সে খিচুরি চাপালো। মুগ ডাল নেই। মুসুর ডালের খিচুরি। ওতেই হবে। হলও। বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। একটা ওভেনে চালডাল ফুটছে। আমিষ খিচুরি হবে। রেসিপিটা তাকে কল্লোল বলেছে। কল্লোলকে হুমায়ুন বলেছে। চেইন অফ সাইটেশন, সে’টা ইবন বলেছে। হুমায়ুনকে কে বলেছে কে জানে? অন্য ওভেনে কড়াই তে সর্ষের তেলে জিরে, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিল ইলতুৎ। কেউ একটা শব্দ করে হাঁচল। ইলতুৎ ঘুরে দেখল, স্যমন্তক।

“হাঁচছিস যে বড়ো? দূরে থাক। কাছে আসবি না। বারণ আছে।”

“এ’টা শুকনো লঙ্কার হাঁচি। আমার কিছু হয়নি।”

“তবু দূরে থাক।”

“আমি তোর থেকে বড়ো, তুই জানিস?”

“আমি সবথেকে বড়ো। আমি রাজা।”

“তোর তো মোটে দু’বছর বয়স।”

“ঊনতিরিশ, হতভাগা। নির্বাসন দিয়ে দেবো।”

“দে দেখি?”

ইলতুৎমিশ জানে সে স্যমন্তককে নির্বাসন দিতে পারবে না। স্যমন্তক আর কল্লোল একটা চল্লিশের দশকের ঢাউস রেডিওতে থাকে। রেডিওটা বড়ো। দু’জনের দিব্য জায়গা হয়ে যায়। কল্লোল কথা বলে অনেক, কিন্তু মুখচোরা। মুখচোরা বলা ভুল হল। ঘরকুনো। বাইরে বেরোয় না। স্যমন্তক আজকাল খুব বেরোয়। ইবনের আশেপাশে ছোঁকছোঁক করে। গন্ধ সুবিধের নয়।

স্যমন্তক খেতে খেতে বলল, “আলুটা সেদ্ধ হয়নি পুরো।”

“যা দিয়েছি মুখ বুজে খা।”

“তুই তো মরে যাবি। তারপর কী হবে?”

এ’রকম আচমকা প্রসঙ্গ বদল ইলতুৎ কে হকচকিয়ে দিল। সে বলল, “আমি মরে যাবার পর কী হবে সে’টা জেনে আমার কী? যা হবে হবে। ও’সব নিয়ে ভাবি না।” রেডিওর ভিতর থেকে কল্লোল কথা বলা শুরু করল। “ইলতুৎমিশ ডাহা মিথ্যে বলল। তার মৃত্যুর পর কী হবে, সে’টা সে সর্বক্ষণ ভাবে। আর ভাবে ই-” ইলতুৎমিশ রেডিও বন্ধ করে দিল। স্যমন্তক ফ্যাকফ্যাক করে হাসছে। তার চুল লম্বা। উস্কোখুস্কো নয়। কাঁধ ছাড়িয়ে নেমেছে। তাকেও দেখতে সুন্দর হচ্ছে দিন কে দিন। কিন্তু সে চট করে মরবে না। ইলতুৎমিশ তার মৃত্যুকামনা করে না। তার অমঙ্গলকামনাও করে না। ছেলেটাকে দিব্যিই লাগে তার। শুধু ইবনের মন নিয়ে তার একটু ইয়ে আছে। নিরাপত্তাহীনতা।

রাত হয়েছে। একটা গোলগাল গোলাপি চাঁদ আসছে যাচ্ছে। দোরগোড়ায় বসে কল্লোলের গল্প শুনছে ইলতুৎমিশ। এই দোরগোড়ায় বসেই বিকেলে বিস্কুট-চা খেয়েছিল সে। কল্লোল খুব সুন্দর গল্প বলে। কিন্তু এখন ইলতুৎমিশের মন পড়ে রয়েছে অন্য কোথাও। স্যমন্তক ইবনকে গান শোনাচ্ছে? চাঁদের উপর মেঘের আনাগোনার মতো তার চেতনা আসছে যাচ্ছে। শ্রডিঞ্জারের বেড়ালটার নাম কী ছিল? সাইমন? সে বিড়বিড় করে উঠল। সিসিলিয়া, ইউ আর ব্রেকিং মাই হার্ট। কল্লোল বুঝতে পারল, সে গল্প শুনছে না। থেমে গেল। ইলতুৎমিশ আজকাল বড্ড মৃত্যুচিন্তা করছে। একদিকে ব্যাপারটা শান্তিময়। মসৃণ। অন্যদিকে –

একটা কোয়ালা যেমন করে গাছকে আঁকড়ে ধরে, তেমন করে দু’হাত দুই পা দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ইবন বলল, “ইলতু?”ইলতুৎমিশ চমকে উঠল একটু। স্যমন্তক রেডিওর ভিতর থেকে গাইছে। ইবন গলা মেলাচ্ছে নিজের সুরে।”মন্দ করেছে আমাকে ওই দু’টি চোখে।”
ইলতুৎমিশের মরতে ইচ্ছে করছে না।