রাসবিহারীর মোড়ে মাদার টেরেজার ম্যুরাল এর তলায় একটা কেঁদো বাঘ বসে থাবা চাটছিল। তার ঠিক পাশেই একটা ঠেলাওলা তার সদ্য ভাজা ফুলুরির ঝাঁক তেলপুকুর থেকে তুলে ঝুড়িতে রাখছিল। হাতের পিছন দিয়ে নাক ঘষে একটা ঠোঙায় করে আট টাকার ফুলুরি সে বাঘটার সামনে রাখল। বাঘটা বলল, ঘোঁৎ। তারপর ঠোঙায় মুখ ঢোকালো। ফুলুরিগুলো সদ্য ভাজা। মুচমুচে। বিটনুন ছড়ানো। গোটা চারেক একবারে মুখে পুরে গরমে হুশহাশ করতে লাগল বাঘটা। ভুরু কুঁচকে তাকালো ঠেলাওলার দিকে। ঠেলাওলা কাঁধ ঝাঁকালো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাগজের কফির কাপে সাবধানবাণী থাকে। কশান, কন্টেন্ট মে বি হট। অর্থাৎ ভাগ্য ভালো থাকলে কফিটা গরম পেতেও পারো। মুখ পুড়িয়ো না দয়া করে। ফুলুরির ঠোঙায় সে’রকম কিছু লেখা নেই। ছবিসহ বিশ্বকাপের খেলার প্রতিবেদন আছে। তেলে চুপচুপে। ভিতরের দিকে বাপ্পাদার টিউশনির বিজ্ঞাপন। বাঘটা একটা ঝড়ালো ফুঁ দিলো ঠোঙায়। কিছু বিটনুন, কিছু ধুলো, আর একটা ফুলুরি উড়ে গেল। কিছুই ঠাণ্ডা হল না। বাঘ ঠোঙাটা মুখে করে উঠে দাঁড়াল।

সাদার্ন অ্যাভিন্যুর দিক থেকে এসেছে বাঘটা। হাজরার দিকে যেতে ইচ্ছে করছে না। হাজরার মোড়ে যোগেশ মাইমের কিছু ছাত্রর সঙ্গে তার ঝগড়া হয়েছিল একবার। সে লেজ দুলিয়ে গোঁফ ফুলিয়ে গোটা দক্ষিণ কলকাতা কাঁপিয়ে হুঙ্কার ছেড়েছিল কিছু। ছেলেমেয়েগুলো হেসেছিল। নিঃশব্দে। নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করেছিল। বাঘ তার কিছুই বোঝেনি। যদিও আশুতোষের ছেলেপিলেগুলো তাকে বেশ সম্মান করে। দেশপ্রিয় পার্কের দিকে যাওয়া যায়। যাওয়াই যায়। কিন্তু বাঘ চেতলার দিকে যাওয়াই স্থির করল। কেওড়াতলা তার বড় প্রিয় জায়গা। বৈদ্যুতিক চুল্লী থেকে মাংস পোড়ার সুবাস আসে ভুরভুর করে। রাস্তায় একটা দু’টো ওরাংওটাং অটো ইতিউতি ঘোরাঘুরি করছে। যাত্রী নেই। কেউই নেই। চারটে বড় লাফ আর আড়াইটে মেজো লাফে সে চেতলা সেতুর উপর উঠল। টলটলে স্বচ্ছ জল বইছে নালা দিয়ে। টালিনালায় আজকাল কিছু মানুষকে গুপ্তধনের সন্ধান করতে দেখা যায় মাঝেমধ্যে। ইংরেজ আমলের, বা তারও আগের নৌকোডুবি দেখা যায় নালার তলায়। এখন একটা বালিহাঁস দেখা যাচ্ছে। মড়াপোড়ার গন্ধ আজ আসছে না। দোকান বোধহয় বন্ধ। কেন? মানুষ মরছে না? নাকি কম পড়িয়াছে।

কমই পড়েছে। একজন বেশ্যা সায়া ব্লাউজ পরে সেতুর রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মানুষের অভাব। বাঘ দাঁড়িয়ে তাকে দেখল। তারপর ফুলুরির ঠোঙাটা তার হাতে ধরিয়ে দিল। চেতলায় বসন্তসন্ধ্যা নামছে। রাধাচূড়া গাছটার মাথায় শয়ে শয়ে পাখি চিল্লামিল্লি করছে। তার তলায় টপাটপ অ্যা পড়ছে। দু’জনে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখতে লাগল।
বেশ্যা বলল, “ও বাবা! রগড় দ্যাখো! আমার বরের ফুলুরি এনে আমাকেই খাওয়াচ্ছে।”
বাঘ বলল, ঘোঁৎ।
বেশ্যা বলল, ” বা রে! আমার বরের ফুলুরি আমি চিনব না? ফুলুরি থেকেই তো প্রেম। কালিঘাটের সেরা ফুলুরিওলা আমার বর।”
ঘোঁৎ।
“ধামা ধামা ফুলুরি উড়ে যেত চোখের পলকে। মণ্ডলের থেকে বরফ জলে রাখা মাল তুলত, আমার বরের থেকে ফুলুরি নিত। তারপর আসত আমার কাছে।”
ঘোঁৎ।
“আয় উকুন বেছে দিই।”

বাঘ একটা লাফ দিলো। তার গায়ে উকুন নেই। সে বাঁদর নয়। সেতু থেকে নীচে নেমে নালার পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগল সে। একটা বেপাড়ার ঘড়িয়াল আড্ডা গেড়েছে এ অঞ্চলে কোথাও। লোক সুবিধের নয়। ধড়িবাজ। জলে নেমে কাজ নেই। আলো থাকবেনা বেশিক্ষণ আর। সাঁঝবাতি জ্বলতে শুরু করেছে। আর দু’লাফ মারলেই আলিপুর।