আমি কেমন করে গানবাজনার প্রতি এত আসক্ত হয়ে পড়লাম, এ’টা অনেক বন্ধু জিজ্ঞেস করে। সবারই বাড়িতে হয় মা গান করেন, নয়ত বাবা, কিছু না হোক বাড়িতে একটা হারমোনিয়াম তো থাকেই। আমাকে প্রত্যেকবার বলতে হয়েছে আমার বাড়িতে কেউ ওইদিকে নেই। কারুর গলায় সুর নেই, কেউ কোনও যন্ত্র বাজাতে পারে না। ইচ্ছেটা পুরোপুরি নিজে থেকে, চারপাশ থেকে এসেছে।

আজ ভাবতে গিয়ে বুঝতে পারছি, কথাটা সত্যি নয়। আমার ছোটবেলার অনেক স্মৃতি খুব তাজা রয়েছে, অনেক ছোটবেলারও অনেক অকিঞ্চিৎকর জিনিসপত্র কীভাবে যে মাথায় থেকে যায়, অবাক লাগে।
খুব ছোটবেলায় আমার মনে আছে, কিছু ছড়ানোর পর বকা খাবার সময় হলে পুরানো সেই দিনের কথা গাইতাম। বাবা বাবার বেসুরো বেতালা গলায় শিখিয়েছিল। গাইতাম, কারণ গানটা গাইলে আদর জুটত। ধারণা হয়েছিল বকা খাবার সময় হলে, ওই গানটা গাইলে উলটে আদর জুটবে। পাভলভের রবীন্দ্রসঙ্গীত। আর একটু বড় হয়ে মনে আছে আমি আর বাবা একটা গোটা সপ্তাহ ধরে রোজ আমার বেলা যে যায় গাইতাম। সুরে সুরে সুর মিলত না, তবু গাইতাম।

বাবা সুমনের ক্যাসেট এনে দিয়েছিল। বাবা অঞ্জনের ক্যাসেট এনে দিয়েছিল। বাবা ডেনভারের ক্যাসেট এনে দিয়েছিল, ডিলানের ক্যাসেট এনে দিয়েছিল, পীট সিগারের একটা পোস্টার অবধি ছিল বাড়িতে। কথা কিচ্ছু বুঝতাম না, বাবা বুঝিয়ে দিত। একটা গোটা রবিবার আমি আর বাবা ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড এর লিরিক্স মুখস্থ করেছিলাম। তারপর সেই ক্যাসেটে ট্যাম্বোরিন ম্যান চালিয়ে বলেছিল, বল তো, চেনা লাগছে? আমি খুব খুব অবাক হয়ে বুঝেছিলাম সুমনের গানওলার সঙ্গে কোথায় যেন মিল। আমি তখন খুব ই ছোট। ট্যাম্বরিন শব্দটার মানে জানি কারণ একটা ছড়া-গান বাবা-ই শিখিয়েছিল আরও ছোট থাকতে। জন দ্য লিট্‌ল প্লেজ দ্য ফিড্‌ল, পাপা প্লেজ দ্য ড্রাম্‌স, মামা প্লেজ দ্য ট্যাম্বরিন অ্যান্ড বেবি সাক্‌স দ্য থাম্ব। আমার তখন আঙুল চোষবারই বয়স। কতটা পথ চললে পরে মানুষ হওয়া যায় আর হাউ মেনি মাইল্‌স এর মিল ধরতে তাই বছর আষ্টেক বয়সে অসুবিধে হয়নি।

হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার ইটার্নিটি বলে একটা অ্যালবাম বাবা-ই এনে দিয়েছিল। বাবা ধ্রুপদী সঙ্গীতের কিচ্ছু বোঝে না। তবু আলি আকবর খানের গান চলত কিছু। আমার প্রথম বাঁশির ক্লাসের দিন নন্দনে আলি আকবর খানের স্মরণসভা ছিল। তার কিছুদিন আগেই মারা গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। বাবা-ই খোঁজ রেখেছিল, নিয়ে গেছিল আমায়।

পরোক্ষ হলেও প্রচুর প্রভাব আমি পেয়ে এসেছি ছোট থেকে। সে’টাকে জিইয়ে রেখেছি হয়ত নিজে, শুধু শোনা থেকে বাজানোতে উত্তরণও হয়ত নিজের ইচ্ছেতে, কিন্তু শুরুটা বাবার কাছেই। লেখার মতোই।

যেমনটা হয়ে থাকে।