অথচ দিনটা এ’রকম হবার কথা ছিল না। সেই ছোটবেলায় একটা বিজ্ঞান ম্যাজিক মার্কা জিনিস হত না? দিব্যি দেখছি আগুনের শিখা, কিন্তু হাত দিলে গরম লাগছে না? ও’রকম আলো অর্ডার দেওয়া ছিল। বেশ উজ্জ্বল, দিব্যি জোরালো ছায়া, কিন্তু গরম নেই। ফুরফুরে ঘামহীন শীত। একটা লোককে দায়িত্ব দেওয়া ছিল রাস্তায় ভুল করে চল্লিশের দশকের নিউ ইয়র্ক ভেবে নেমে পড়তে। হাঁটু অবধি ওভারকোট। হ্যাট। জুতো। সব কালো। মায় ব্রিফকেসটাও। নাকি অ্যাটাচি কেস? কে জানে। সে নামবে রাস্তায়। হাঁটবে ফুটপাথে। উলটো দিক থেকে আসা একটা মোটকু ওভারঅল পরা লোকের সঙ্গে কাঁধে ধাক্কা লেগে কফি চলকাবে। কবজিতে, কোটের হাতায়। দাঁত কিড়মিড় করে একটা গালাগাল দেবে চল্লিশ। ওভারঅল শুনেও শুনবে না, ভিড়ে মিশে যাবে। এ’রকম কথা ছিল। ম্যাগাজিনের দোকানের লোকটা খড়কে কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে সেদিনের খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন পড়বে মন দিয়ে। রাস্তাঘাটে হেব্বি জ্যাম হবে। ম্যানহোল থেকে সাদা গলগলে ধোঁয়া উঠবে, তাই দেখে কারুর একটা মনরো হবার সাধ হবে। কিন্তু সে সে’দিন স্কার্ট পরে বেরোয়নি। ধুৎ। ট্যাক্সিওলা একটা ধূপকাঠি নেড়ে ড্যাশবোর্ডে রাখা জগন্নাথকে পুজো দেবে। তার বউনি ঘড়ি দেখতে দেখতে হনহনিয়ে আসছে। ট্যাক্সি ওলা গাড়ি স্টার্ট দিতে গিয়ে দেখবে স্টিয়ারিং এধার ওধার হয়ে গেছে। তাজ্জব! ট্র্যাফিক পুলিশটা গোবরে পা দেবে। দিয়ে ভীষণ বিরক্ত হয়ে ঘাস খুঁজবে জুতো মোছার জন্য। সেই সুযোগে একটা হেলমেট না পরা বাইকওলা সুরুৎ করে লাল আলো ডিঙিয়ে ডান দিকে ঘুরে যাবে। অটোকাকু তার রোজকার শানুর ক্যাসেট খুঁজে না পেয়ে রেডিও চালাবে, আর একটা চূড়ান্ত খাপছাড়া পাহাড়ি গান বাজবে শহরের ট্র্যাফিকে। মোটকথা একটা সুন্দর সাধারণ দিন হবার কথা ছিল। ইলতুৎমিশের বসে থাকার কথা ছিল শেয়ালদা স্টেশনে। কোনও মানুষ একা নড়ছে না। সার বেঁধে সৈন্যের মতো একটা আস্ত শরীর হয়ে নড়ছে। একটা শরীর প্ল্যাটফর্ম বেয়ে বেরিয়ে আসছে, একটা আড়াআড়ি কাটছে, একটা সাত নম্বরের দিকে এগোচ্ছে। কারুর চলা গন্তব্যহীন নয়, অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একক নয়। শুধু ইলতুৎমিশ একা দাঁড়িয়ে থাকবে। বা বসে। কোথাও একটা হেলান দিয়ে। ভিড়ের স্রোতে দ্বীপ হয়ে। এইরকম কথা হয়ে ছিল। হল না।
মরচে ধরা মেঘলা দিন একটা। কনকনে ঠাণ্ডা। হাওয়ায় চোখ থেকে জল পড়ছে। ইলতুৎমিশ অবাক হয়ে দেখল, রাস্তায় কোনও হলুদ গাড়ি নেই। লাল গাড়ি নেই। নীল, সবুজ, বাদামী, কিচ্ছু নেই। সাদা গাড়ি। আর কালো গাড়ি। তাও হাতে গোনা। একটা দু’টো ছাতা এধার ওধার করছে। খুব করে নাক মুখ ঢেকে একটা হাতে বোনা উলের মানুষ রাস্তা পেরোচ্ছে। ছিঁড়েখুড়ে সুতো বেরিয়ে পড়েছে এখানে সেখানে। কার্ডবোর্ডের বাক্সকে বিছানা বানিয়ে আরেকটা ময়লা উলের গোলা ঘুমোচ্ছে। একটু ছাউনি অবধি নেই। খিদিরপুর ব্রিজে ওঠার মুখে একটা নতুন সাইনবোর্ড চোখে পড়ল ইলতুৎমিশের। দেখতে নতুন নয়, যেন এখানেই ছিল আজীবন। একটা হলুদ বরফির মধ্যে কালো অক্ষরে লেখা ব্রিজেস আইস বিফোর রোড্স। সেতুরা বুঝি শীতকাতুরে হয়? রাস্তার আগেই জমে যায়? টালিনালার কালো জলে সাদা ফেনা। এইখানে ব্রিজের ঠিক নীচে অন্যদিন একটা লোক বসে টিয়াপাখি নিয়ে। ভবিষ্যৎ গণনা করে। টিয়াওলা ডাকল। “সম্রাট! সম্রাট ইলতুৎমিশ। একটু দাঁড়িয়ে যান!” ইলতুৎমিশ দাঁড়াল। পিছন ফিরল। টিয়াওলা গলা নামিয়ে বলল, “কাল একটা আজব জিনিস হয়েছে জাঁহাপনা। এমনিতে কেউ ভবিষ্যৎ গোনাতে এলে আমি খাঁচা খুলে দি, ময়না এসে একটা তাস ঠোঁটে করে তুলে দেখায়।” ইলতুৎমিশ বলল, “টিয়ার নাম রেখেছ ময়না? অদ্ভুত তো!” টিয়াওলা বলল, “এ হল তোতাপাখি। টিয়া নয়। দেখতে সবুজ। কিন্তু তোতা। আমার একটা টিয়া ছিল, তার নাম ছিল চন্দনা।” ইলতুৎ সামনে বিছানো চটে বসল। বলল, “বলো, কী বলবে…”। তোতাওলা বলল, “সে ভারী আজব ব্যাপার। কেমন করে যেন ময়না দরজা খুলে ফেলেছে খাঁচার। খুলে পালাতে পারত। পালায় নি। একটা তাস এনে আমায় দিল। তাতে আপনার ছবি। আমি গণনা করে দেখলাম, জানেন, যে আপনি আজ এখান দিয়ে যাবেন, আর আপনার জন্য একটা সন্দেশ থাকবে।” ইলতুৎ ভুরু কোঁচকালো। তোতাওলা দরজা খুলে দিল। ময়না বেরিয়ে এলো গুটিগুটি। একটা তাস তুলল মুখে করে। তোতাওলা সে’টা তুলে নেবার পর সে ফেরত চলে গেল খাঁচায়। মুখে করে দরজা আটকে দিল। তোতাওলা কেমন একটা করে তাকিয়ে রইল তাসটার দিকে। রুইতন। তারপর বলল, “কোনও কলমা আসছে না খোদাবক্স। একটা শব্দ আসছে শুধু।” ভুরু দিয়ে প্রশ্ন করল ইলতুৎ। তোতাওলা বলল, “অভিমান। আপনার যা ইচ্ছে হয় দেবেন।” ইলতুৎ তার গলা থেকে একটা মুক্তোর হার খুলে দিয়ে দিল তাকে। তারপর অবাক হল একটু, মুক্তোর হার সে কবে থেকে পরা শুরু করল? ঘষ্টে নীল জিন্স, ছাই ফুলশার্ট, আর গলায় মুক্তোর হার? হবেও বা। কতকিছুই হচ্ছে যা হবার কথা নয়। তোতাওলা বলল, “হুজুর মহান। এ হার আমি বেচব না। ভুখা থাকি, থাকব। এ হার বেচা হারাম। যমুনা আমায় ক্ষমা করবে না।” সম্রাট ইলতুৎমিশ চমকে উঠে দেখল খিদিরপুর ব্রিজের তলা দিয়ে যমুনা বইছে। টলটলে জল। দূরে, জলের ট্যাঙ্কির তলায় একটা দরগা। আর এই পারে জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে একটা সাদা চূড়ো দেখা যাচ্ছে। তাই থেকে একটা পতাকা পতপত করে উড়ছে। কীর্তনের মতো কী একটা শোনা যাচ্ছে। স্পষ্ট নয়। শুধু খোলটা পরিষ্কার। সে’টাই যথেষ্ট। ইলতুৎমিশ কীর্তন চেনে। কিন্তু এই শহরটা চেনে না। একটা হিজিবিজবিজ রকমের ঘটনা ঘটছে। অস্তিত্বের সংজ্ঞা বদলাচ্ছে সময়ের সঙ্গে। সকালবেলা নাম থাকে আলুনারকোল, আর বিকেল হলেই সে’টা হয়ে যায় তকাই।
হেঁটে হেস্টিংস এর মোড় (বা কুড়ি মিনিট আগেও যে’টা হেস্টিংস এর মোড় ছিল) অবধি পৌঁছল ইলতুৎমিশ। রেসকোর্সের কাছাকাছি এসে টের পেলো শহর থেকে গন্ধ উবে গেছে। ঘোড়া ঘোড়া গন্ধ হয়ে থাকে এখানে সবসময়। নেই। টালিনালার পচা গন্ধও পায়নি। নো কচুরি। নো কচুরিপানা। নিঃশ্বাস নিতে ঝাল লাগে। সিগনালে একটা কালো ক্যাডিলাক এসে দাঁড়ালো। জানালার কাচ নামানো। ভিতরে বসা একজন আফ্রিকান আমেরিকান মানুষ। সিগারেট খাচ্ছে। গাড়ির ভিতরটা ধোঁয়ায় ভরা। গুমগুম করে বেস বাজছে একটা খুব চেনা গানের অন্তরার। তার থেকে গলা তুলে ইলতুৎমিশ জানতে চাইল, ভাই, এ কোন শহর? লোকটা যেন বাংলা বুঝে উত্তর দিল, মেম্ফিস। তারপর সদ্য সবুজ সিগনালের আহ্বানে সাড়া দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল। যতদূর দেখা যায়, গাড়িটাকে দেখতে লাগল ইলতুৎ। রাস্তার ওপাশে বড় সবুজ সাইনবোর্ড। মিসিসিপি রিভার ওয়াক, একজিট ৩৩১, ১ মাইল। টালি নালা হল কখনও যমুনা, কখনও বা মিসিসিপি। একটা দস্তুরমতো পাঁচমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে ইলতুৎ ভাবতে লাগল আর সব শহর ছেড়ে তার খিদিরপুর মথুরা হয়ে মেম্ফিসে এলো কেমন করে। তারপর ক্যাডিলাকে শোনা গানটার স্থায়ীটা মনে পড়ল তার। ইফ ইয়ু লাভ সামবডি এনাফ, ইয়ু’ল গো হোয়ারেভার দে গো, দ্যাট’স হাউ আই গট টু মেম্ফিস। টম টি হল।
মেঘটা একটু একটু করে কাটছে। এখন আকাশের অর্ধেকটা ধূসর। বাকিটা নীল। বসন্ত বিকালখানি মেঘে রোদে অভিমানী। হাওয়া দিচ্ছে এখনও। ছাতা ওড়ানো হাওয়া। কিন্তু ছাতার আর প্রয়োজন নেই। চ্যাটার্জী ইন্টারন্যাশনালের ছাদ থেকে সেন্ট পলের গীর্জা দেখা যাচ্ছে। পায়ের নীচে ইন্টারস্টেট পঁচাত্তর। সে রাজপথ একটা খুব চেনা সেতু ধরে একটা নদী পেরিয়ে ওপারের একটা শহরে ঢুকেছে। সে নদীর কোনও নাম নেই। সে সেতুর উপর একটা খালি গা কীর্তনীয়ার দল খোল বাঁশি হারমোনিয়াম নিয়ে গাইতে গাইতে শহরে যাচ্ছে। কী বা তোমার অঙ্গে রাখি, কীভাবে সাজাই, ভাবি তুমি সঙ্গে নেবে, বেকুব বনে যাই। ইলতুৎমিশ শান্তি পেয়েছে। মথুরা নগরপতি সম্রাট ইলতুৎমিশ আর একটু হাঁটলেই গোকুলে পৌঁছে যাবে। আর একটু হাঁটলেই মেম্ফিস। আর একটু হাঁটলেই মেঘের মধ্যে একটা নাম-বলা-যাবেনা শহর। গঙ্গা পেরোতে হবে। যমুনা পেরোতে হবে। মিসিসিপি পেরোতে হবে। আর একটা নাম-বলা-যাবেনা নদী পেরোতে হবে। পেরিয়ে একটা নাম-বলা-যাবেনা ক্লাবের আড্ডায় একটা মেয়ে। তাকে আমরা ইবন বতুতা নামে চিনি। আর একটু হাঁটলেই।
ইলতুৎমিশ আর একটু হাঁটবে কিনা ঠিক করেনি। একটা টিয়া বা তোতা বা ময়না তার কানে ফিসফিস করছে।
অভিমান।