চুলে, গালে, দাড়িতে বালি বালি হয়ে রয়েছে। মুখের মধ্যে কিচকিচ। থুঃ করে একদলা থুথু ফেললেও সে কিচকিচ যাচ্ছে না। জল নেই যে কুলকুচি করবে। তিন চারবার থুথু ফেলল ইলতুৎমিশ। চুল ঝাড়ল। জামা ঝাড়ল। বালিতে ঘুমোলে এই হয়। বালিতে সে ঘুমোয়নি। মানে ঘুমিয়ে যখন পড়েছিল তখন এই মরুভূমিতে ছিল না। উঠে দেখছে এই অবস্থা। ইলতুৎমিশ কখনও মরুভূমি দেখে নি। রাজস্থান গেছে। জয়পুর। তাকে মরুভূমি বলা চলে না কোনও ভাবেই। “বালি আর কেল্লার কথা যখন বলছে, পশ্চিম রাজস্থানের কথাই তো মনে হয়”। জয়পুরমে বালি নেহি হ্যায়। অ্যারিজোনা, ইউটাহ্ গেছে। কিন্তু “উঁট চরে কি?”র উত্তরে না বলতে হলে ইবনের হিসেবে তার মরুভূমিত্ব কাটা যায়। বেশ দিগন্ত বিস্তৃত ঢেউ খেলানো বালির ঢিবি। মনসাঝোপ। তিন দাঁড়া-ওলা ক্যাকটাস। চন্দ্রবিন্দুপ্রাপ্ত মরুচরদের ফসিল্‌স। লক্ষ্মীছাড়া মরীচিকা। আলটপকা খেজুড়গাছ। তবে না মরুভূমি? ইলতুৎমিশের জন্ম মরুভূমিতে, এ’রকমই কথিত। মা-ও তাই বলেছে। বাবা জুতোতে বালি নিয়ে ঢুকলে সে ভেবে এসেছে সমুদ্র এসেছে বুঝি তাদের পাড়ায়। কিন্তু তার মরুভূমি মনে পড়েনা। কালোর উপর হলুদ সবুজ নকশা করা তাঁবুও মনে নেই, শুধু একটা হলদে ছবিতে সেই তাঁবুর সামনে বসে থাকা ছোট্ট ইলতুর ছবিটা রয়ে গেছে। আজ মরুভূমিতে এসে তার মনে হচ্ছে সে সবই সত্যি। বাহারি তাঁবু সত্যি, মরূদ্যানের দীঘি থেকে কলসি কাঁখে উঠে আসা রমণীরা সত্যি, বেলাবারের হাটে উঁটে বোঝাই সওদা আসা সত্যি, তিন পাশের তাঁবুতে থাকা বুড়ি হাত-দেখিয়ে সত্যি, তাঁর সব কথা ফলে যাওয়াও সত্যি। সত্যি তাহলে ইবন বতুতাও। খয়েরগঞ্জের কেল্লায় যার সাথে আলাপ। যার নেশা এখনও ইলতুৎমিশের রন্ধ্রে। ভার্সাই এর অ্যালেক্স দ্য আর্কিটেক্ট ও তাহলে সত্যি?
তার গোড়ালির কাছে বালিতে একটু আলোড়ন উঠল। ইলতুৎমিশ পা সরিয়ে নিল। গা ঝাড়া দিয়ে একটা কালো কুচকুচে কাঁকড়াবিছে বেরিয়ে এলো বালির তলা থেকে। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, “পাতালের রাজা কে জানো?” ইলতুৎমিশ বলল, যম। “উহুঁ। প্লুটো। ভূগর্ভের রাজা। পাতাল মানেই নরক নাকি?” তাও বটে।
“তুমি যমদূত না প্লুটোদূত?”
“আমি ফ্রিল্যান্স। আমার নাম কালান্তক।”
বালির মসৃণ বুকে অদ্ভুত নকশা ফেলতে ফেলতে এগিয়ে চলল কালান্তক। ইলতুৎমিশ পিছু নিল।
“তেষ্টা পেয়েছে।”
কালান্তক কিছু বলল না। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল শুধু। সে তাকানোর অনেক রকম মানে হয়। “মরুভূমিতে তেষ্টা পাবে না তো কোথায় পাবে?” ও হয়, “রোসো বাবা, এত চাই চাই করলে চলে?” ও হয়। ইলতুৎমিশ চুপচাপ চলতে লাগল। অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। গলা খুশখুশ করছে। কিন্তু “কোনও প্রশ্ন নয়” ধারা জারি আছে। বলা যায় না, দিলো হুলিয়ে। মারাত্মক বিচ্ছু। চোখ ছোটছোট করে হাঁটা। বড্ড উজ্জ্বল সবকিছু। চটিতে বালি ঢুকছে। কিন্তু কিরকির করছে না। পা তেতেপুড়ে ঝলসে যাওয়া উচিৎ। যাচ্ছে না। মৃদু তেষ্টা পাচ্ছে শুধু।
কতক্ষণ হাঁটল ওরা ইলতুৎমিশ ঠিক ঠাহর করতে পারল না। তেষ্টা সয়ে গেছে। কী করে কে জানে। সূর্য্য পাততাড়ি গোটানোর আয়োজন করছে। সূর্য্যের বাড়ি কোথায়? পাটে। ইলতুৎমিশ পাটের কাছে বেশ ক’টা তেকোণা জিনিস দেখতে পেলো। নকশা কাটা হলুদ ঢিবিতে কমলা হয়ে পড়েছে আলো। আর সেই দিগন্তজ আলোয় লম্বা হয়ে ছায়া পড়েছে জিনিসগুলোর। প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে বিধিনিষেধ ভুলে গেল ইলতুৎমিশ। “ওগুলো পিরামিড? পিরামিড ওগুলো?” কাঁকড়াবিছেদের হাসলে খুব সুন্দর দেখায়। কালান্তক হেসে এক পাক ঘুরে নিয়ে বলল “বাচ্চা তুমি। হবে। পিরামিড হবে। সম্রাটদর্শন হবে। সব হবে। কিন্তু ওগুলো তাঁবু। ও’টা তাঁবুর শহর। মরূদ্যান। ওর নাম মালি।” ওমনি! বাগানের নাম মালি? দিঘীর নাম ঝিনুক? কালান্তক মাথা নাড়ল। সম্মতিসূচক। ইলতুৎমিশ চমকে গেল। এই কথাগুলো সে জোরে জোরে বলেনি। মনে মনে বলেছে। কালান্তক বলল, “না। আমি মন পড়তে জানিনা। কিন্তু তোমার মুখ দেখে মনে হল মনে পড়ছে তোমার। কেমন? পড়ছে না? বাগানের নাম মালি। দীঘির নাম ঝিনুক। আর কী মনে পড়ছে?” ছোট্টবেলায়, খুব ঝড়জল কান্নাকাটির দিনে বোনটি বলেছিল, মনে পড়ছে। বাগানের নাম মালি। দীঘির নাম ঝিনুক। ইলতুৎমিশের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “আর মালির নাম ইবন বতুতা।”

ঝিনুকের জলে মায়া আছে। ঢেউ আছে। প্রাণভরে আঁজলা করে জল খেলো ইলতুৎমিশ। সেই জল যে শরীরের নালিপথ বেয়ে আনাচ কানাচে পৌঁছে যাচ্ছে, সে’টা টের পেলো সে। হাত বেয়ে নখের ডগা অবধি। নিজের শিরা ধমনীগুলোকে যেন সচেতন ভাবে বোধ করতে পারছে। মুখে এক ঝাপটা দিয়ে উঠে বসে বাইরের পৃথিবীটা সম্বন্ধে সে সচেতন হল। কত লোক। কত্ত লোক। কত রঙিন পোশাক তাঁদের। অথচ ভিড় বলে মনে হচ্ছে না। যে যার নিজেদের মতো ছোট ছোট দলে বসে গল্প করছে। নিজের পরণের সাদা আলখাল্লাটার দিকে তাকালো ইলতুৎমিশ। আবারও চমকে দিয়ে কথা বলে উঠল কালান্তক। “দু’টো দল আছে পৃথিবীতে। একটা দল উপরে উপরে। উপরেই। কেউ কাউকে চেনে না। কাউকে কাউকে চেনে। তাদের খুব হুল্লোড়। আরেকটা দল তলায় তলায়। তারাও কেউ কাউকে চেনেনা। কিন্তু সবাই সবাই কে চেনে। খুঁজে বের করে। এই দিন গুলোতে খুঁজে পায়। উপরের দলটা উপরে চলে যায়। আর তলার দলটা একা পড়ে যায়। তখন তারা নিজেদের আবিষ্কার করে। আরেঃবাহঃ তুমিও এই দুনিয়ার মানুষ?” ইলতুৎমিশ যেন বুঝতে পারল কালান্তক কী বলছে। বুঝিয়ে বলতে বললে আমতা আমতা করবে। কিন্তু সে নিজে যেন বুঝতে পেরেছে। মানেটা ধরতে পেরেছে। শুধু সে এ’টা জানেনা, তার এখানে অস্তিত্বের অর্থ কী। কেন সে ঘুম ভেঙে উঠে একটা কদাকার কথা বলা হাসলে সুন্দর দেখায় কাঁকড়াবিছের পিছুপিছু ঝিনুক দীঘির পাশে মালি বাগানে এসেছে। কী কাজ তার এখানে?
জলের পাশে বালিতে তারা দু’জন বসে রয়েছে। ঠিক পিছনেই একটা সাদা কালো তাঁবুতে একদল লোক নীল পাগড়ি পরে গানবাজনা করছে। সেই সুর শুনতে শুনতে অবাক হয়ে যাচ্ছে ইলতুৎমিশ। একবর্ণও কথা বুঝছে না। কিন্তু সুরটা এত চেনা কেন? একা কেউ গাইছে না। দু’টো তিনটে তারযন্ত্র। বেশ ক’টা তালবাদ্য। ঝুঁকে ঝুঁকে কেঁপে কেঁপে দুলে দুলে বাজাচ্ছে। নেশার মতো দুলুনি। ইলতুৎমিশও দুলছে। গাইছে সবাই। সহজ একটা সুর। ইলতুৎমিশও গাইতে পারে। গাইতেই পারে। কথা জানা নেই নেহাৎ। উলু দিচ্ছে শোনো ওরা। উলু দিচ্ছে। ছেলে মেয়ে বুড়ো সব্বাই। এ কেমন ধারা কথা। এ সাঁওতালী সুর এরা পেলো কেমন করে?
“তিনারিওয়েন”
ইলতুৎমিশ চমকে ঘুরে তাকালো। একটা উঁট। কখন এসে চার হাঁটু মুড়ে বসেছে পাশে। জাবর কাটছে। ইলতুৎমিশ প্রশ্ন করল চোখ দিয়ে।
“তিনারিওয়েন। ওদের নাম। ওই দলটা। ভবঘুরেদের দল। তিনারিওয়েন মানে মরুভূমি। ওরাই মরুভূমি, ইলতুৎমিশ।” ইলতুৎমিশ জানতেও চাইল না, উঁটটা ওর নাম জানল কী করে। ওর আর কিছুই অবাক লাগছে না। সুরটা পালটে গেছে। গান না থেমেই। এমনি এমনি। এই সুরটাও চেনা। বোলপুরের সরু পিচের রাস্তা দিয়ে সবুজ মিনিবাস এর ছাদে চড়ে যাওয়ার মতো ছন্দ। প্রশ্নোত্তরের খেলা। একজন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে। সবাই মিলে জবাব দিচ্ছে। ইলতুৎমিশ দুলতে দুলতে নিজের মতো করে কথা বসিয়ে নিল।
“এই মরুভূমিতে সবচেয়ে দরাজ কাহার মন?”
“ইবন বতুতা, সে ই সবচাইতে আপন।”
ওরা গাইছে
“মাতাদিয়েম ইন্মিক্সিয়াম সল্মেকাদেম?”
“পরয়ে ইয়াআদেম, পরভে মাআহাআরুম”
“আমার নাম হামলাল।” উঁটটা বলল। চিবোতে চিবোতে। একটা ভীষণ সুন্দর বরফি খোপ নীল লাল হলুদ কমলা জিনের পোশাক পরে আছে সে। আরও কী একটা বলতে যাচ্ছিল, একটা গাধা দৌড়তে দৌড়তে এসে ব্রেক কষে থামল ওদের কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “কী মুশকিল, সময় হয়ে এলো যে। সাড়ে ছ’টা বাজল। এখনও কুমীর এলো না?”
ইলতুৎমিশের বেশ মজা লাগছে। কেমন উৎসব উৎসব ব্যাপার। হাল্কা রাত্রিবাসরীয় শীত পড়ছে। সে বলল, “জলকে নেমে দেখেছ?” গাধাটা একবার তাকাল। তারপর সটান নেমে গেল ঝিনুকের জলে। একটা ঠাণ্ডা চাঁদের মুখ পড়েছিল জলে, সে’টা ঘেঁটে গেল। আর ঠিক সেইখান থেকে একটা ভিজে কালো আলখাল্লা পরা মানুষ যেন ডুব দিয়ে উঠল। ইলতুৎমিশের শিঁড়দাড়া সোজা হয়ে গেল। মানুষটার গায়ে আলখাল্লাটা লেপ্টে আছে। কোমরজল থেকে উঠে আসছে সে। একপাশে মাথা হেলিয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছে। যেমন ভাবে বিজ্ঞাপনে মেয়েরা মোছে। একগোছা ছোট করে কাটা চুল, দুই হাতে তোয়ালের মধ্যে নিয়ে আলতো করে মোছা। ছেলেদের মতো গামছায় মুখ মাথা ঢুকে এলোপাথাড়ি রগড়ানো নয়। মেয়েদের স্নান দেখা উচিৎ নয়। কিন্তু একটুও নজর সরাতে ইচ্ছে করছে না ইলতুৎমিশের। নাভির কাছটা ছোট্ট হয়ে কালো কাপড় ঢুকে আছে যেমন, বুকের কাছটা আছে উঠে। বৃন্ত দেখে মনে হচ্ছে জামা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে। ইলতুৎমিশের মুখ হাঁ হয়ে গেছিল। হামলুল চুকচুক করে উঠল। কালান্তক লেজ হুলিয়ে দাঁড়াল। ঢোঁক গিলে চোখ সরাল ইলতুৎমিশ। ভেজা পায়ে বালি মেখে এসে দাঁড়াল ইবন বতুতা। বলল, “একটু বোস, আমি কাপড় বদলে আসছি।” মুখ ঘুরিয়ে ইবনের চলে যাওয়াটা দেখবার সাহস হল না ইলতুৎমিশের। সে শুধু দেখল এই ফাঁকে একটা কুমীর এসে জুটেছে। কুকুরের মতো গা ঝাড়া দিল ভয়ানক জানোয়ারটা। জল ছিটে এসে মুখে চোখে লাগল সবার।
কালান্তক সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। কুমীরের নাম শেয়ালচোর। গাধার নাম চন্দ্রবিন্দু। গাধাটা হাসতে হাসতে বলল, “ইবন ওই জন্য উঁটকে বলে উট আর গাধাকে বলে গাঁধা।” সে’দিন রাতে একটা কাঁকড়াবিছে, একটা উট, একটা গাঁধা, একটা কুমীর, একটা ইলতুৎমিশ, আর একটা ইবন বতুতা রওনা দিলো মালিবাগান আর ঝিনুকদীঘি ছেড়ে। ইবনের কোলে উঠল কালান্তক। ইবন আর ইলতু চড়ে বসল হামলালের পিঠে। ব্যাক্ট্রিয়ান উঁট, তার পিঠে দু’টি কুঁজ। আর একটু পরেই পাট ভেঙে উঠে আসবে সূর্য্য। সেই পূব দিকের দিগন্তে চলল ছ’টা প্রাণী। ইবন ফিসফিস করে ইলতুর কানে বলল “তুতানখামেনকে দেখবি না ইলতু?” ইলতুৎমিশ ইতঃস্তত করে বলল, “তুতান মরে যায়নি?” পূবের হাওয়ায় তিনারিওয়েনের সুর ভেসে এলো রাতভোরে। তুতানরা মরে না। জন্মায়। বারে বারে। তুতান একটা তুঁতে রঙের মাছ। বতু একটা বাদামী বিড়াল।
ইলতুৎমিশ একটা হাঁক পেড়ে বলল, “চলিয়ে জী রামদেওরা।”