মাটিতে যখন ফাটল ধরল, মেয়েটা তখন থেবড়ে বসে আকাশ দেখছিল। রাতের আকাশ। রাতের পর রাত সে আকাশ দেখে। রাত্রিবেলা আর খুব একটা কিছু করা হয়না। করার থাকেনা। আগুন আসতে দেড় নিযুত বছর দেরী। বছর আসতে বোধহয় তিন নিযুত। লক্ষ্মী আসেননি। লক্ষ্মী পেঁচা এসেছে। মেয়েটা যেই গাছে হেলান দিয়ে বসে আকাশ দেখছে, পেঁচা সেই গাছেরই সবচেয়ে নীচের ডাল থেকে মেয়েটাকে দেখছে। এ’রকম একটা নিস্পন্দ রাত্তিরে পায়ের তলার মাটি দুলে উঠল হঠাৎ। আশেপাশের সব জাগন্ত ঘুমন্ত প্রাণী নড়েচড়ে উঠল। আর সব গাছ থেকে আর সব পাখি ঝাঁকুনি খেয়ে বেসামাল হয়ে বৃক্ষচ্যুত হয়ে পাকা ফলের মতো মাটিতে পড়তে পড়তে সামলে নিল। মেয়েটার কোনও ভাবান্তর হল না। লক্ষ্মীপেঁচাটাও বিশেষ উত্তেজিত হল না, তিনশো ষাট ডিগ্রী ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে নিল শুধু, তারপর মেয়েটার উপর মনোনিবেশ করল।

সবাই উঠে দাঁড়াল। মাটির দিকে তাকিয়ে শব্দ করতে লাগল। সে শব্দের অর্থ নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তাকে ভাষা বোধহয় বলা চলে না। ভাষারও আসতে অনেক বাকি। কিন্তু ভয় এসেছে। আদিম মানুষগুলো তাদের আদিম বুদ্ধিতে এই ধড়ফড়ানির কারণ অনুধাবন করার চেষ্টা করছে। ভগবানকে ডাকা সম্ভব নয়, ভগবান তখনও আসেননি। মানুষগুলো এইটুক জানে, মাটিতে কম্পন হয় যখন ভারী কিছু তাকে আঘাত করে। দুই হাতি সমান লোমশ দাঁতাল ম্যামথ হাঁটাচলা করলে তারা টের পায় পায়ের তলায়। কিন্তু তার প্রবলতা অনেক কম। কত বড় জানোয়ার হলে… আবার! আরও জোরে! টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল কেউ কেউ। হাতের কাছে যা পেলো, ধরবার চেষ্টা করল। তারপর দেখল তাদের মাঝখান দিয়ে আড়াআড়ি একটা ফাটল তৈরী হয়েছে মাটিতে। নির্ভেজাল, অকৃত্রিম, বিশুদ্ধ আতঙ্কে বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে তারা ছুট দিল, ফাটল থেকে দূরে। বসে রইল শুধু সেই মেয়েটা, আর একটা পেঁচা। আর আকাশজোড়া চকমকি পাথর।

“লুসি, কী আঁকলে দেখি?” বছর ছাব্বিশের শিক্ষিকা ঝুঁকে পড়লেন বছর আটের লুসির ডেস্কের উপর। সাদা পাতার মাঝবরাবর একটা সরল রেখা। উপরটা কালচে নীল। নীলের মধ্যে অনেকগুলো হলদে সাদা বিন্দু। তলাটা ঘন সবুজ। একটা গাছ। গাছের তলায় একটা মেয়ে। গাছের ডালে একটা পেঁচা। “কী সুন্দর! এই মেয়েটা বুঝি তুমি?” লুসি একরকম দুর্বোধ্য ঘাড়নাড়া শিখেছে মায়ের কাছে। হতেও পারে, না হলেও আশ্চর্যের কিছু নয়, এই গোছের। “ছবিটার নাম কী?” লুসি এবার মুখ তুলল। “নাম?”
“ছবিদের নাম থাকে তো! নইলে এই ছবিটা যে’দিন বিখ্যাত হয়ে যাবে, তখন লোকে কীভাবে বলবে সেই ছবিটার কথা?”
“লুসি।”
“সে তো তোমার নাম।”
“মোনালিসার ছবির নাম ও তো মোনালিসা।”
“কিন্তু সে ছবি তো মোনালিসা আঁকেননি। এঁকেছেন…”
“লাইক এ ডায়মন্ড ইন দ্য স্কাই।”
“বাহ! দিব্যি নাম!”
“বাজে নাম।”
“তবে ভালো নাম কোনটা?”

জুলিয়ান অদ্ভুত দেখতে চারটে গুবরেপোকার ছবি এঁকেছিল। তিনজনের হাতে গিটার। একজনেরটা উলটো হাতে ধরা। ম্যাম শুধরে দেবার চেষ্টা করেছিলেন। জুলিয়ান গম্ভীর হয়ে বলেছিল, “ও এমনিই ধরে”। মহিলা আর ঘাঁটাননি। চতুর্থজনের হাতে কাঠি, গলায় ঝোলানো ঢোল। ছবির নাম জানতে চাওয়ায় বলেছিল লঙ্কা সেনাপতির একলা পোকার দল। সবাই হেসেছিল। লুসি হাসেনি। সে গুবরেপোকাদের ছবিটা চেয়ে নিয়েছিল, বদলে নিজের ছবিটা দিয়ে দিয়েছিল জুলিয়ানকে। জুলিয়ান বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বাবাকে দেখিয়েছিল ছবিটা।

তার বছর সাতেক পরে অনেক দক্ষিণের একটা দেশে দিনদুপুরে ঘুম ভেঙে একটা পেঁচা বেরিয়ে এসেছিল একটা গাছের কোটর থেকে। কর্কশ ডেকে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে ফিরে গিয়েছিল গর্তে। কোদাল শাবল নিয়ে ধুধু প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে থাকা একদল মানুষ বলেছিল, তবে ওই গাছ থেকেই শুরু করা যাক। ধৈর্য্যের কাজ। পরিশ্রমের কাজ। তাঁবুর ভিতরে রাখা রেডিও চালিয়ে খুব সাবধানে মাটি খুঁড়তে শুরু করলেন তারা, জীবাশ্মের আশায়। শেষ বিকেলে যখন সাড়ে তিন নিযুত বছর পুরোনো একটা মেয়ের কিছু অবশিষ্ট বেরোলো, রেডিওর ভিতর থেকে তখন জুলিয়ানের বাবা গাইছেন, লুসি ইন দ্য স্কাই উইথ ডায়মন্ডস।