পিঁপড়ের সারি অনুসরণ করা ইলতুৎমিশের একটা বিশেষ ভালোলাগার কাজ ছিল। প্রায় কর্তব্যের মতন। সে ভারী নিষ্ঠা ভরে পিঁপড়ে সেনার মুড়ো ল্যাজা খুঁজে বের করত। প্রায় কর্তব্যের মতো। ইলতুৎমিশ একজন অভিযাত্রী। পৃথিবীর সবথেকে গণ্যমান্য অভিযাত্রী কোন জাতি? ইলতুৎমিশ ভাইকিংদের কথা জানত না তখনও। কলম্বাসকে নেহাৎ আকাট মনে হত তার। ভাস্কো, দ্য গামা পালোয়ানের অন্য উদ্দেশ্য ছিল। ব্যবসা। জালি মাল। হিউয়েন সাং স্কলারশিপ পেয়ে পড়াশোনা করতে এসেছিলেন। এক মার্কো পোলোকে মনে ধরেছিল ইলতুৎমিশের। কিন্তু সে ব্যাটা গেছো দাদা। ইবন বতুতার সঙ্গে তখনও মিশের আলাপ হয়নি। হলে তখন থেকেই সে ন্যাওটা হয়ে পড়ত মহিলার।
না, কিন্তু জাতি হিসেবে দেখলে সবথেকে বড় অভিযাত্রী কারা? সাইবেরিয়ার দক্ষিণমুখী পাখির ঝাঁক? বাবার সঙ্গে চিড়িয়াখানায় গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে এসেছে ইলতুৎমিশ। বাঘের খাঁচার দশহাত থেকে বিকট গন্ধ আসে। তাছাড়া উকুন ওলা বাঘ দেখতে মোটেই ভালো লাগেনা ইলতুৎমিশের। পাখিগুলো ছাড়া থাকে। পরিযায়ী পাখিগুলো। সেইরকম একজন সারসের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল ইলতুৎমিশ।
– আপনি বাংলা বোঝেন?
– অল্পস্কি স্বল্পস্কি। প্রতি বছরসিয়েভ সাইবেরিয়া থেকেস্কেই আসি তো।
– কেন আসেন বলবেন?
– আজ্ঞেস্কি বড় ঠাণ্ডা পড়ে যে। আপিস টাপিস থেকে ছুটিকভ নিয়ে…
– এত লম্বা শীতের ছুটি?
– বাজে বোকো না ছোকরা। আমরা পুজোর ছুটিও পাইনা। গরমের ছুটিও না। এই আমাদের একমাত্র ছুটি।
– এইত্তো ঝরঝরে বাংলা বলছেন।
এমন সময় একটা পাতিবক উড়ে এসে জুড়ে বসে বলল, “এর কথায় বিশ্বাস কোরো না কিন্তু। টালা পার্কের সারস ইনি। সাইবেরিয়ান সাজা হচ্চে! টালা থেকে আলিপুর আসতে দশবার রাস্তা শুধোতে হয়েচে, ইনি যাবেন সাইবেরিয়া! আমার ইন্টারভ্যু নিতে পারো। আমার মেসোর বাড়ি কাজিরাঙায়!”
ইলতুৎমিশ মনের দুঃখে গণ্ডার না দেখেই চলে এসেছিল।
যাক্গে, জাতি হিসেবে সবথেকে বড়ো অভিযাত্রী আপাততঃ পিঁপড়েরা। তাদের সাইজ অনুযায়ী কত্তদূর যায় তারা ভাবো তো? এই সারিটাকে ইলতু খুঁজে পেয়েছিল পড়ার টেবিলের গায়ে জানালার সীলের উপর। হিসেব করে দেখল এর দক্ষিণ পূর্ব কোণের দিকে মুখ করে চলেছে। ইলতু আগে উৎস সন্ধান করবে ঠিক করল। উৎস বেরোলো ঠাকুর্দার ঘরের দরজার পিছনে দেওয়াল আর মেঝের সংযুক্তিতে, একটা ফুটোয়। ইলতুৎমিশ দৌড়ে পড়ার টেবিলের কাছে এলো। পিঁপড়ের দল সেই ঘরেরই পশ্চিম জানালার কাছে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। জানালাটা বন্ধ। ইলতু জানলাটা খুলল। জানালার পাল্লা আর ফ্রেমের মধ্যে একটা টিকটিকি চাপা পড়েছে। থেঁৎলে গিয়েছে। চেপ্টে লেপ্টে আছে ফ্রেমের সঙ্গে। এখন একটুও মাংস অবশিষ্ট নেই তার গায়ে। শুধু চ্যাপ্টা কঙ্কাল একটা। ডাইনোসর ছিল। ইলতু ভাবে। সত্যিই ছিলো। জুরাসিক পার্কের টিরানোর মুণ্ডুটা কয়েকশোগুন ক্ষুদ্রিয়ে নিলেই টিকটিকির মুণ্ডু।
**********************
অভিযাত্রীদের কি উদ্বাস্তু বলা চলে? উঁহু। একদল নিজের ইচ্ছেয় ঘর ছাড়ে। একদল দায়ে পড়ে। হাজার দেশের হাজার মানুষের সঙ্গে কিছু বাঙালি এখানে জড়ো হয়ে আছে। অল্প ক’জন। ঠিক উদ্বাস্তুও নয়, আবার অভিযাত্রীও বলা চলে না। ঔপনিবেশিক? একটা অন্যরকমের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এরা। কাজের জন্যে, বিদ্যার্জনের জন্যে এসেছে। ফেরত যাবে না প্রায় কেউই। ছিমছাম কলোনি। ছড়ানো। দেখা হলে শুঁড়ে শুঁড় মিলিয়ে নমস্কার জানায়। তিথি অতিথিতে ভোজ জমায়। সারি বেঁধে কাজের জায়গায় যায়। উহুঁ, পিঁপড়েরা অভিযাত্রী নয়, এখানে এসে ধারণা হয়েছে ইলতুৎমিশের। সে বহিরাগত। এরা সবাইই তাই। তবু এদের মধ্যেও শিকড়হীন ইলতুৎমিশ। ক্ষণস্থায়ী। বছরের পর বছর ধরে ক্ষণস্থায়ী। পিঁপড়েদের কলোনি থাকে। যেখানে খাবার, সেখানে বাসা। কিন্তু বাসা থাকে বইকী। ইলতুর বাসা নেই। আজ পালাবো কাল পালাবো করে পালানো হচ্ছে না। বয়স বাড়ছে। ইবন বতুতা গম্ভীর হয়ে ঘাড় নেড়ে বলছে “প্রথমে শিয়ালদা, তারপর কল্যাণী, তারপর অ্যালবাকার্কি, তারপর পেরু…” পায়ের কাছে বসে ইলতুৎমিশ শুনছে। আর মাথা নাড়ছে। বিড়বিড় করছে। “আজ মন্টুগোমারি, কাল আবু ধাবি, পরশু দমদমা, তরশু কলুটোলা…” ইবন ধমক মেরে বলছে “অ্যাই ইলতু! ইনকামিং না আউটগোয়িং? এই না তুই অভিযাত্রী?”
ইলতুৎমিশের মনে বিরিঞ্চিবাবা ভেসে উঠছে। এই হল গিয়ে বর্তমান। ইনকামিং আর আউটগোয়িং এর মাঝখানে। যেখানে ইলতুৎমিশ আর ইবন বতুতার অশান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। যেখানে জানালার পাল্লা আর ফ্রেমের মধ্যিখানে টিকটিকির মত চেপ্টে রয়েছে ইলতুৎমিশের আঙুল। ফুলে উঠেছে বেগুনী হয়ে।
আর সে’টা লক্ষ্য করে এগোচ্ছে কিছু পিঁপড়ে।