জানালা ঘেঁষে বসবে এসো আলোতে। আমি হাত পড়তে পারি। এই যেমন এখন তোমার হাত দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সকালের আলুর তরকারিতে হলুদ বেশি হয়েছিল। তোমার এ’বেলা ও’বেলা ছাতে উঠে বরাদ্দ হাওয়ার সঙ্গে যে কিছু ধোঁয়াও থাকে, তা দেখতে পাচ্ছি নখদর্পণে। এই যে, এই রেখাটা, তালু চিরে মধ্যমার নীচ থেকে প্রায় কবজি অবধি নেমেছে, একে বলে ঢ্যাঁড়া। এত বড় ঢ্যাঁড়া থাকার অর্থ হচ্ছে আমার কপালে দুঃখ আছে। আজ্ঞে, অন্যের হাত দেখে নিজের ভাগ্যও গণনা করা যায়। সবাই পারে না। আমি পারি। তোমার হাতে ঝুঁকে দেখলে যে দেখছে তার কপালের ছায়া পড়বে না? যাই হোক, এই ঢ্যঁড়া কে জ্যামিতিক নৈখুঁত্যে বাইসেক্ট করে যে রেখাটা গেছে, তার নাম নিরক্ষরেখা। তার মানে হল এই যে, আমি নিরক্ষর, হাত পড়তে পারি না। কেবল পড়ার অছিলায় ধরতে পেয়েছি। আর এই যে ঢ্যাঁড়া নিরক্ষের প্রয়াগ ঘিরে যে বৃত্তটা, যাকে গোল্লা বলে, সে’টা যে অনুপস্থিত, সে’টা বলে দিচ্ছে আমার অভিসন্ধি তুমি ভালোই জানো, কিন্তু এই ভনিতাটুকু না করলে, সোজাসুজি “তোমার হাতটা একটু ধরব?” বললে কেমন ক্যাবলা ক্যাবলা শোনাতো, তার চেয়ে এই ভালো।

তোমার সঙ্গে থাকলে আমি সন্ধ্যে দিতে ভুলে যাই। অম্মা বলেছে সন্ধ্যে কেবল সন্ধ্যেতেই দিতে হবে তার কোনও মানে নেই। সকাল বিকেল যে কোনও সময় দেওয়া যায়। স্নানের পরে তোয়ালে জড়িয়ে দিই আমি। নমো নমো করে। কোন ঠাকুর জানিনা। ঠাকুরের পায়ের কাছে ধূপের ছাই। কিন্তু আজকাল ভুলে যাই। ব্যস। ঠাকুর ও ভুলে যায় আমায় নমো নমো করতে। পাঁউরুটি সেঁকতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলি। শশা ময়লার বালতিতে ফেলে খোসা ঢুকিয়ে রাখি ফ্রিজে। ছিপ নিয়ে যায় কোলাব্যাঙে মাঝেরহাটের ব্রিজে। বাইরের ঘরের মেঝেয় চৌকো হয়ে আলো পড়ে। সাড়ে চারটের পড়ন্ত, কিন্তু পড়তে অনেক বাকি, সূর্যের আলো। আমার পায়ের পাতা ঠাণ্ডা হয়ে গেলে ওতে সেঁকি। সেই কবে দেখা হয়েছিল। বয়স প্রাপ্তি হয়নি তখনও। পোস্টাপিসে খোলা খাতায় জমছিল। পাঁচ টাকার স্ট্যাম্প কিনতে গেলে পোস্টমাস্টার বলল “বেশ কিছু চিঠি জমেছে তোমার, আর এত্তখানি বয়স। নিয়ে যাও।” বয়স ডিম পাড়ে। সুদে আসলে বাড়ে। চক্রবৃদ্ধি। ছাদে টাঙানো কাপড় শুকোতে দেবার দড়ির মত টানটান হয়ে থাকতাম আমি। আর হলুদ ক্লিপ দিয়ে আটকানো ব্লাউজের মতো তুমি ঝুলতে। সেই থেকে হাওয়ায় আমার ভয়।

চিঠিগুলোর বয়ান সব একই। আছি। এইত্তো। এই দ্যাখ! কই? মাঝেমধ্যে ওই ঘর থেকে আওয়াজ পাই। ভূতের সিনেমার খিলখিলে হাসি নয়। বেসুরো গলার গান। প্রায় জং ধরতে বসা আমার ক্রোমাটিক হারমোনিকায় প্রশ্বাস। মনেই থাকে না যে নেই। “জানো তো, শোবার ঘরের আয়নাটা-” বলতে বলতে ঢুকে থেমে যাই। ঘর ফাঁকা। মেঝেতে চৌকো রোদ। মনে কলঘরে জলের শব্দ পেলাম। এবার দরজা খুলবে। “আয়নাটা? ভেঙেছিস?” খুব কখনও দিনমানে বা রাতদুপুরে এক আধটা ঘরে ঢুকতে গিয়ে মুখে চোখে মাকড়সার জালের মতো কিছু জড়িয়ে যায়। পাগলের মতো ঝাড়তে থাকি। মুছতে থাকি। চুল কেটে ফেলব। সব। দাড়ি। গোঁফ। সব। টাকলা মাকুন্দ একটা লোক হয়ে যাবো একদিন।

খুব অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গায় ভালোবাসা লুকিয়ে গেছ কিছু। মশলার কৌটোর পিছনে একটা হলদে চিমসানো ঠোঙায় সে’দিন অল্প একটু খুঁজে পেলাম। ও’খানে কে রেখে যায় মিয়ানো পিরীত? তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে চিমটে করে তুলে গোঁফে মেখে নিই। থাকবে কিছুক্ষণ গন্ধটা। ভালোবাসা গন্ধ বই আর কিছু তো নয়। আমি রঙকানা কিনা পরীক্ষা করেছিলে একদিন। একটা কাগজে কতগুলো রঙের মধ্যে প্রায় সেই রঙেরই, একটু হাল্কা অথবা গাঢ় করে কিছু লেখা। লেখাগুলো পড়তে হবে। সবক’টা পারিনি। এখনও নিয়ে বসি অবসরে। একটা আধটা হুট করে পেরে যাই। শব্দজব্দ মেলানোর মতো আনন্দ হয়। মনে মনে ভাবি, তুমি একজন গুপ্তচর। আমি জানিই না তোমার আসল নাম আদৌ ইবন বতুতা কিনা। কেউ জানে? যে জানে, তাকে হিংসে হয়। কেমন গুপ্তচর তুমি? সিনেমার মতন? পা দেখানো লাল রঙের ছোট্ট জামা? ইয়াব্বড় গোড়ালি ওলা জুতো? ঝুঁকে পড়ে তোমার বুকের এক ঝলক দেখিয়ে শত্রুর মনঃসংযোগ নষ্ট করো? তোমার উরুর ভিতর দিকে বন্দুক বাঁধা? চুলের কাঁটা আমূল বিঁধিয়ে দিয়ে খুন করতে পারো অবলীলায়? আমি জানি, পারো। তোমার হাতে লেখা আছে এ’সব। সুপ্তরেখা।

এত দিনে হয়ত নাম বদলে নিয়েছ।