খুব ভোরের দিকে, সাঁতার কাটা ভোরের দিকে একটা শিরশিরানি হত। এখন হয় কিনা জানিনা। ভোর বলেই আদপে কিছু আছে কিনা জানিনা। স্কুল যাবার সময় জানালার পাশে বসে হাওয়া মাখতাম। মানা ছিলো। সিজন চেঞ্জ। ঠাণ্ডা লাগবে। লাগুক। এমনিই যেন লাগে না। গায়ে কাঁটা দিত। প্রেম করতাম না। কিন্তু বিরহ বুড়বুড়ি কাটত। গাছে ফলে থাকত মন খারাপ। তলা দিয়ে যাবার সময় মাথায় কাঁধে পড়ত। সারা বছর অমনোযোগী থাকতাম, কিন্তু সে’টা আর সবার কাছে। বারো নম্বরের এসে টাইপ প্রশ্নের কাছে। রোল কলের সময় মিস হয়ে যাওয়া নিজের নম্বরের কাছে। রিপোর্ট কার্ডের মন্তব্যে, গার্জেন কলের নালিশে। “আপনার ছেলে বড্ড ছটফটে। খাতার পিছনে ক্রিকেটারদের ছবি এঁকে রাখে। সারাক্ষণ কথা বলে ক্লাসে। কী এত গল্প ওর?” এই যে। এই সব গল্প। বয়স কম হলে কি পুরোনো সেই দিনের কথা থাকতে নেই? আমায় বলেছিল দেবযানী আন্টি। অনেক ছোট তখন, গ্যালিস দেওয়া হাফপ্যান্ট। কী ভাবত সবাই? প্যান্ট খুলে যাবে ক্লাসে? আমায় নিয়ে সবাই তাই ভাবে। প্যান্ট খুলে যাবে বলে গ্যালিস। চশমা পড়ে যাবে বলে ঘাড় ঘুরে আসা দড়ি। যে দড়ি দিয়ে নড়বড়ে দাঁত উপড়ে দিয়েছিল শৌর্য। যাই হোক, মোটকথা অমনোযোগী বলে খ্যাতি ছিল আমার। জানালার বাইরে তাকিয়ে ভাবতাম, “এই আমি ইস্কুলে এসেছি, এই নিশ্চয়ই বাড়িতে লোক এসেছে। বাইরের ঘরে বসিয়েছে। এই চা বসাল। এই শিঙাড়া। শিঙারার একটা শিং। গণ্ডারের মতো।” “অ্যাই ফটিক! হল লং ডিভিশন?” ওরা ভুল বলত না। এখনই প্রাক্পুজো ভোরের কথা বলতে গিয়ে বাইপাস হয়ে যাচ্ছে। শুধু বানান ভুল কম হয় এখন। সারা বছর অমনোযোগী। সবার কাছে। অন্য কিছুতে মন। কিন্তু ওই ভোরগুলোয় নিজের কাছেও। অন্যমনস্ক। ক্রিকেটে মন নেই। বাঁদরামিতে মন নেই। বেনরিকের মাঠের পাশে ফুলহীন রাধাচূড়ার তলাটা সাদা হলুদ পাখির অ্যা তে ভর্তি, গন্ধে মম। ওইতে মন। দুঃখ দুঃখ ভাবটাকে আয়েশ করে পুষছি। আলাদা বসছি। কথা কম বলছি। “কী হয়েছে” জিজ্ঞেস করলে মৃদু হাসছি।
তারপর বেলা বাড়লে শহরের আর আমার আসল রূপ বেরিয়ে পড়ত। প্যাচপেচে গরম। বগলে ঘেমো বৃত্ত। ভবানীপুর টু এস্প্ল্যানেড মার্কেটিং এর মিছিল। এখন মার্কেটিং মানে সেল্স পিচ, আর কেনাকাটি মানে শপিং। তখন ছিল পাটের তৈরী ঢাউস শপিং ব্যাগ। তাদের বেতের হাতল। ইডেনের প্রথম ঘন্টার কুয়াশা কেটে গেলে কেমন স্লো ব্যাটিং পিচ হয়ে যেত মাঠটা। একধরণের টুপি হত না? মাথাটা খোলা, শুধু কপালে চোখের উপর একটা ঢাকা। অদ্ভুত! কালে ভদ্রে একটা চার হচ্ছে। ভাল্লাগছেনা। বাড়ি যাবো।
এখানে এ’রকম হয়ে থাকে। শিরশিরানি। সারা সকাল সন্ধ্যে জুড়ে। দৈবাৎ দুপুরে ঘুমিয়ে পড়লে সন্ধ্যেতে ঘুম ভাঙে। উঠে সেই পৌনে অন্ধকার দেখে জোরে জোরে নাক টানি। ছাতিম কই? ছাতিম? মনে হয় হেঁটে ডাউনটাউন অবধি গেলেই চন্দননগরের আলো লাগানো দেখতে পাবো। টুনি গুলো না জ্বললে নকশা উদ্ধার করা সম্ভব না। একই চৌকোয় হাজার নকশা। আলো জ্বললে তবে এক এক করে ফুটে ওঠে। সকালে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে গায়ে কাঁটা দেয়। আমি টকেটিভ? বাচাল? কেউ “অল গুড” বললে হেসে মাথা নাড়ি। প্রত্যেক বছর এই সময়টা এ’রকম হয়ে থাকে। প্রতি বছর। গত বছর একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম একদিন। আমার শ্যাওলা সিঁড়ি থেকে রেলের মাঠ অবধি হেঁটে গিয়ে পেট্রোল পাম্প টা কে দেখে স্টেশন ভেবে ফেলেছিলাম। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ইলতুৎমিশ সকালে উঠে নাক ঝাড়লে, গলা খাঁকারি দিলে শ্লেষ্মার সঙ্গে ফটিক উঠে আসে বেসিনে।
কতদিন বাড়ি যাইনা। কতদিন শুয়ে শুয়ে পা দোলালে আমার বাড়ির নোনাধরা দেওয়াল থেকে প্লাস্টার অফ প্যারিস আর চুন সুরকির গুঁড়ো খসে পড়েনা মেঝেতে। কতদিন পাখার দিকে তাকিয়ে সিলিংকুসুম ভাবি না। সেই বাড়িটা আর আছে? বাবা মা শিলিগুড়িতে এখন। থাকতে না পেরে মা-কে বলে ফেললাম। মন খারাপ। মায়ের নাক লাল হয়ে গেল। “যাবো না বাড়ি আমরাও। কী হবে গিয়ে? ষষ্ঠীর সকালে হাঁটতে বেরোলে দেখি সবার ছেলে বাড়ি ফিরছে। ট্যাক্সিতে। বড় বড় ব্যাগ।” আহারে। কেন বললাম মা কে? না মা, আমি দিব্যি আছি। ঝকঝকে তকতকে ঘর আমার। তোমার ঘরও অত পরিষ্কার নয়! বললেই খ্যাঁক করে উঠবে। “কে করত নোংরা? অত গুলো ঘর! একদিন ও হাত লাগিয়েছিস?” হেহে। শেষ দু’বার বাড়ি ফিরেছিলাম না বলে। চমকে দেবার ইচ্ছে। সে’টা একরকম ভালোলাগা। কিন্তু মা একটু মন খারাপ করেছিল। “বলে আসতে কী হয়? এই যে ছেলে আসবে ছেলে আসবে ভাবটা, এ’টা রোদ পোয়ানোর মত আনন্দ দেয়। ঘড়ি দেখা, রিকশা স্ট্যান্ড এ চোখ রাখা, গাড়ির আওয়াজ এলেই বারান্দায় ছোটা, বাবাকে দিয়ে বাজার করানো, মন দিয়ে রান্না করা। কবে বুঝবি?” এবার থেকে বলে কয়ে যাবো। কবে যাবো? ভাল্লাগছেনা।
বাচালরা কথা বলতে না পেলে পেট ঢোল হয়ে যায়। ওই জন্য মুটিয়েছি। ওই জন্য লিখি। বের করে দি। যা। যা তো। এতো পাত্তা দেবার কী আছে? একটা দিদি শাল দিয়েছিল এনে দেশ থেকে। এই শিরশিরানি একমাত্র ওতে কাবু। হাফ প্যান্ট গেঞ্জি পরে ছেলেপুলে ক্লাস করতে আসে। আমি শাল গায়ে পড়াই। ক’টা জামা হল তোদের পুজোয়? ইল্লী! পরীক্ষা তখন। মিড টার্ম। প্রথম বর্ষদের প্রথম পরীক্ষা। পুজো! আকাশটা নীল হয়ে থাকে। দূষণ নেই। ভূষণ আছে। সাদা লেজ এঁকে যায় প্লেনগুলো। কোন চুলোয় যায়? বাড়ি যায়? রোদের রঙ ডিমের কুসুমের মতো।
আমার এত ঠাণ্ডা লাগে না রে ভাই। আমি শীতকাতুরে নই। শূন্যের নীচে না নামলে পারতপক্ষে ফুল সোয়েটার পরি না। আজ কেন এত ঠাণ্ডা লাগছে? এমনি এমনি গাড়ির ভিতর বসে থাকি। ভিতরটা গরম। ওমের মতো। ওর নাম মীরাবাঈ। ওকে খুব ভালোবাসি।
একদিন অনেক উঁচুতে চলে যাবো। টঙে। এখন যেমন ফটিককে দেখতে পাচ্ছি বারান্দায় কাঠটগরের পিঁপড়ে দেখতে দেখতে দাঁত মাজছে, তখন ইলতুৎমিশ কে দেখতে পাবো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাঙা নোলা পিড়িং পাকুম কে দেখতে দেখতে দাঁত মাজছে। দেখব বতু বলছে, “আমার সামনে ছাড়া কাঁদবি না, হুঁ?” দেখব চিমনি দিয়ে গুড়ের পায়েস বেরোচ্ছে, কড়াইশুঁটির কচুরি বেরোচ্ছে, পুজোর জামা বেরোচ্ছে, ন্যাপথলিন বেরোচ্ছে, কিশোর ভারতী বেরোচ্ছে…
তখন অবার্নের জন্য মন খারাপ হবে।