নোলা একদম সহবৎ জানেনা। অবশ্য ওর বয়স ও বেশি হয়নি। গায়ের রঙ পাকেনি। মাথার উপর একটা আজকালকার বাচ্চাদের মতো হাল ফ্যাশানের ঝুঁটি রেখেছে। লাল। নোলা কাকাতুয়া নয়। নোলা কার্ডিনাল। যারা লুচি কে নুচি বলে, তাদেরই কেউ কার্ডিলাল কে কার্ডিনাল নাম রেখেছে। আমি নোলা বলি। নোলার নাম নোলা কারণ ওর বড্ড নোলা। রাতদিন খাইখাই। রাঙাদির নাম রাঙাদি কারণ রাঙাদি রাঙা। আশ্চর্য! আমার বারান্দার পাখি, আমি যা নাম দেবো তাই হবে, হয়েছে? তোমরা কী নাম দাও পাখির? ঊষসী? ঊর্মিমালা?

নোলা রাঙাদির মেয়ে। মানে, আমার তাই ধারণা। ছেলেও হতে পারে, কিন্তু, মনে হয় মেয়ে। রাঙাদি ছোট্ট ছাল ছাড়ানো নোলাকে খাওয়াতে নিয়ে আসত বারান্দায়। একটা দোলনা বাটিতে খাবার থাকে, একটা ইমনি বাটিতে জল। নোলা খেতে চাইত না। রাঙাদি বলত না খেলে বিকেলে খেলতে যেতে দেবেনা। নোলা দোলনা বাটিতে নেমে পড়ত। দুলত। ছড়াত। দু’দানা খেত। আর রাঙাদি বারান্দার উপর কার্নিশে বসে নজর রাখত। এখন নোলা একলা আসে। লায়েক হয়েছে। টিনেজার। রাঙাদির ভয়, কোনদিন ছেলে জুটিয়ে ফষ্টিনষ্টি করে বাসায় এসে বলবে আলাদা বাসা চাই, ডিম পাড়ব। নিজের বাসা ছাড়া ছেলে বিয়ে করলে রাঙাদি মেরে ঠ্যাঙ ভেঙে দেবে। কচি মেয়ে, এখনও সবুজ পালক শরীরে। ডানাগুলোয় লাল ধরেছে। ভারী সুন্দর। কিন্তু ওই। সহবৎ জানেনা। আমি বারান্দায় গেলেই পালিয়ে যায়। কেন? হাজার হোক আমার ভাড়াটে তোরা। না দিস ভাড়া, ফ্রি-তে খেতে দি, জল দি। বৃষ্টির সময় ছাদ দি। একদিনও বলেছি ধরতে পারলে তন্দুরি বানিয়ে খাবো? এত অশ্রদ্ধা কীসের? বসে তো দু’টো গল্পও করতে পারিস?

একবার একদিন ঝড়বাদলের পরে বাড়ির সামনে দেওয়ালের এক কোণে একটা পাখি পড়ে ছিল। নট নড়নচড়ন। চোখ পিটপিট। তুলে আনলাম। হাতে করে। প্রথমে পালাবার চেষ্টা করছিল, তারপর হাতেই ঘুমিয়ে পড়ল। ঘরের হিটার অন করে দিয়েছিলাম। একটা কাঠের টুকরো তুলে এনেছিলাম, তাইতে বসে বসে ঘুমোত। নোলাদের খাবার দিয়েছিলাম, মুখে তুলল না। অল্প নুন চিনির জল খেলো। ইবন একজন পক্ষীবিশারদ। দেখেই বলে দিলো, “এই তো। রাণীক্ষেত হয়েছে। নিজেই সেরে যাবে।” রাণীক্ষেত। কী অদ্ভুত সুন্দর নাম একটা রোগের! রাণীক্ষেত। বসন্ত। কর্কট। আমাদের বাংলায় এই সব রোগ হয়। তোমাদের হয় হুপিং কাশি। তা আমার আগন্তুকের রাণীক্ষেত সেরে গিয়েছিল। উড়ে গিয়েছিল নিজেই। একবারও “এলাম” বলে যায়নি। নাম ও জানা হয়নি ওর। মধ্যবয়স্ক পাখি। ধূসর সবুজ। পাখিগুলো এমনিই হয়। বজ্জাত। ইবনের মতো কপাল করলে একটা ঘাঁচু কি একটা রুকু জোটে। রুকু ইবন বতুতা বলতে পারে না। বিন্তি বিন্তি বিন্তি করে চেঁচায়। আমায় দেখে চোখ পাকিয়ে বলেছিল, “এক কানের গোড়ায়।” তবু আমায় রুকুকে ভালো লাগে। বদমেজাজি টিয়া। ইবনের নাকি তিরিক্ষে মেজাজের বুড়ো বুড়ি ভালো লাগে। যারা উঠতে বসতে মেজাজ দেখায়। পান থেকে চুন খসলে খিস্তি করে। অদ্ভুত। ওইজন্য আমায় ওর পছন্দ নয়। বিস্তর উত্যক্ত করে। আমার রাগ বেরোয় না। ইবন কাগজ ভাঁজ করে করে একটা ঘাঁচু বানিয়েছিল। কমলা ঘাঁচু। ঘাঁচু আদপেই কমলা নয়। আর পাঁচটা পায়রার মতোই। গলার কাছে রামধনু। আমি ঘাঁচুকে দেখিনি। শুনেছি। পড়ার টেবিলে বসে থাকত।

নোলাকে দেখে দু’টো ছেলে ঝারি মারে। নোলার থেকে ছোট। কথা বলতে সাহসে কুলোয় না। আর বাপরে বাপ কী ছটফটে! ডানাগুলো কাঁপে যখন দেখাই যায় না। পিড়িং কে আগেই দেখেছি। খেতে বসত না। উড়তে উড়তে খেত। ডানা থেকে গুনগুন শব্দ হয় হামিং বার্ড দের। ওর যে বন্ধুটা জুটেছে, সে “ওর সঙ্গে মিশবি না” রকমের বন্ধু। একটু মতিস্থির নেই। হিন্দোলা ওর নাম দিয়েছে পাকুম। বেশ। ছেলেটা নিঃসন্দেহে পাকা। হিন্দোলা একটা রাগের নাম। সবসময় রেগেই আছে। “বলব না, যাও” মার্কা রাগ। হিন্দোলা একটা গুবলু গাবলু পাখি। ঘুঘু পাখি। বতু একটা বাদামি বিড়াল।

ছবিতে বাঁদিক থেকে হিন্দোলা, আগন্তুক, আর রাঙাদি। নোলা, পিড়িং, আর পাকুম এর ছবি তোলা যায়নি। ওরা বড্ড ফটছট করে।