ছেলেবেলায় আমি শিশুশ্রমিক ছিলাম। মশারি প্রতি পঞ্চাশ পয়সা। দু’টো মশারি। এক টাকা। ভিতরের ঘরের মশারির একটা খুঁট খাটের উপর উঠে খুলতে হত। অন্যটা জানালার গোড়ায় পা রেখে, গ্রিল ধরে বেয়ে উঠে, সিল এ দাঁড়িয়ে তবে হাত পেতাম। প্রাণ হাতে করে পয়সা রোজগার করতে হত। অত বড় ধামড়া মশারি পাট করতে গিয়ে গায়ে জড়িয়ে জালে আটকা পরা মাছের মতো খাবি খেতাম। তারপর গিয়ে মিলত এক টাকা। সে’টাকা চালান যেত কর্মকার জুয়েলার্স এর লাল রঙের বালা রাখার পার্সে। বালা মায়ের হাতে। ব্যাগ আমার হাতে। তাতে কুড়ি পয়সার বেনজিন রিং এর মতো ছয়কোণা মুদ্রা, পাঁচ পয়সার চৌকো মুদ্রা, দশের খাঁজ কাটা গোল, আর পঞ্চাশ পয়সা বেশ কিছু। নিজের মতো করে জমাচ্ছিলাম। বিপদে আপদে লাগে। যে কোনও দিন বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে। পরীক্ষার নম্বর বেরোবে গরমের ছুটির পর। ততদিন থাকতে দিচ্ছে, খেতে দিচ্ছে। বদলে বিছানা গুছিয়ে নিচ্ছে। পাশবালিশে ওয়ার পরিয়ে নিচ্ছে। ওই এক একটা ওয়ারে আমি নিজে ঢুকে যাই। পিঠ চুলকিয়ে নিচ্ছে। পাকা চুল বাছিয়ে নিচ্ছে। চশমা খুঁজিয়ে নিচ্ছে। তখনও আমার চশমা হয়নি। সে আজ এক কুড়ি বছর আগেকার কথা।
শুতে যাবার আগে, মশারি টাঙাবার পর একটা উৎসব হত। মশামেধ যজ্ঞ। মা লাশ হয়ে পড়ে। বাইরে বাবা, ভিতরে আমি। আমার কাজ মশারির ভিতরের দিকের কোণায় ঝড় তোলা। হুড়ুম তাড়ুম চাদর নাড়ুম ঝড়। তাতে তিতিবিরক্ত হয়ে একদু’টো যে মশা গা-ঢাকা দিয়ে থাকত, তারা বেরিয়ে আসত ঝড়হীন মশারি অঞ্চলে। একটা কোনও জাল-দেওয়ালে বসত। তারপর আমি গুপী, বাবা বাঘা। মশারির এ’পাশ ও’পাশ থেকে এর হাতে ওর হাতে তালি। সেই প্রবল হাই ফাইভে মশাটা চেপ্টে থাকত জাল-দেওয়ালে। একটু লাল হয়ে থাকত জায়গাটা। অবশ্য মাঝরাতে বাথরুম যেতে গিয়ে ফের কিছু বহিরাগত মশা আমদানি করত মা।
গরম শীতের মাঝের সময়টায় আমাকে পাখার হাওয়া থেকে বঞ্চিত করা হত। আমার নাকি ঠাণ্ডার ধাত আছে। যত মিথ্যে কথা। রীতিমতো গরম লাগত। তার উপর জ্বর-ছাড়া ঘাম। অথচ মায়ের পাখা ছাড়া চলবে না। অ্যাডিপোস। ব্যস। একখানা ধামসা চাদর আমার ঠিক উপরে মশারির চালে পেতে দেওয়া। ছাদ পাখার হাওয়া শুধু মা খাবে, কেমন? মাঝরাতে লাথি মেরে চাদর সরিয়ে দিতাম। সকালে কানমলা। তারপর থেকে মা কে গুঁতিয়ে হাওয়া রাজ্যে অনুপ্রবেশ করতাম। সকালে দেখা যেত বিছানার একটা পাশ ফাঁকা। অন্য পাশে আমি আর মা “এত্ত পপুলেশন বেড়ে গেছে যে আর বলার নয়” নিয়ে আলোচনা করছি।
অবার্নে মশা নেই। মশারিও নেই।