এ বাড়ির দিনের প্রথম অতিথি সিদ্দিকদের বউ। আলো ঠিক করে ফোটবার আগেই এসে ক’টা কাঠটগর পেড়ে নিয়ে যাবে। পাঁচিল থেকে ঝুঁকে। হাতের নাগালে যত আছে, সব। একদিন বারান্দায় লুকিয়ে ছিল তুঘলক। সিদ্দিকিনী এসে রাক্ষসী রাণির মতো হাত বাড়াতেই উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “ফুল নেবেন নিন। সবক’টা নেন কেন বলুন তো? আমাদের জন্য রাখতে নেই?” মহিলা সেই যে ঘোমটা চেপে উলটো দৌড় দিয়েছিল, কক্ষপথ ছাড়িয়ে চলে গেছে অ্যাদ্দিনে। কক্ষপথ নামটা খুব ভালো লাগে ইলতুৎমিশের। ঘরের রাস্তা। কক্ষ। পথ।

দ্বিতীয় হাজিরা শঙ্কর কাগজওলার। সাইকেলের ক্যারিয়ারে বান্ডিল বাঁধা কাগজ। হ্যান্ডেল থেকে ব্যাগ ঝুলছে। তাইতে কাগজ। তুঘলকদের বাড়ি দোতলায় নয়। সাইকেল থেকে হাত বাড়িয়ে বারান্দায় গ্রিলের উপর দৈনিক হাগুবাজার আর বন্দীপুর টাইম্‌স পেতে যেত শঙ্কর। ভোর ভোর। বেশ। মানলাম। কিন্তু তারপরের অতিথি শ্রীমান পাপ্পু মাদার ডেয়ারির দু’টো প্যাকেট ঠিক কাগজের উপর রেখে যেত। ব্যস। সামনের পাতাটা ভিজে ন্যাকড়া। কোনও কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছু নেই গা? তুঘলকের বউ মেহেরুন্নিসা দুধের প্যাকেট কেটে জ্বাল এ বসাত। তারপর বাজারের থলিগুলো তুঘলকের নাকের ডগায় ঝোলাত। “যাচ্ছি। যাচ্ছি। কিছু আনতেই হবে, এ’রকম আছে?” ইলতুৎমিশ মনে মনে বলত, “কাঁকরোল এনো না, তাহলেই হবে। সজনে ডাঁটা তাও চেবানো যায়, কিন্তু কাঁকরোল?” ভূভারতে যত রকম রোল আছে, কাঁকরোল তার মধ্যে সবথেকে বাজে। “দরজাটা দিয়ে দে!” বাবার পিছনে দরজা বন্ধ করে ইলতু শনিবারের মার্কেটে পড়তে বসত। বসত। ওই অবধিই। পড়ত না। কাগজের শেষ পাতা পড়ত। আঁকিবুকি কাটত। ডেরা ইসমাইল খানের যুদ্ধের কথা ভাবত। তারপর মা মেহেরুন্নিসা এসে বলত, “ইলতুউউউউ, এক গেলাস লেবুর শরবৎ করে রাখ লোকটা জন্য। বাইরে চড়া রোদ।” তারপর দরজার বাইরে কিড়িং কিড়িং। দরজা টু রান্নাঘর থলে বওয়ার সার্ভিস। “ব্যায়াম করেছিস?” পায়ের বুড়ো আঙুল ও নাড়ায়নি ইলতু। ব্যায়াম দু’চক্ষের বিষ। শুধু পাখা বন্ধ করে বসে ছিল, যাতে ঘাম হয়। মায়ের দিকে চোখ টিপে বলল, “করেছি। ডিড।” তুঘলক একটা হুঙ্কার ছাড়ল। “ডু আই মুভ উইথ মাই মাউথ ইন দি গ্রাস?” হাতে লেবুজলের গেলাস নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল ইলতুৎমিশ। বাবা মোটেই ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না।

তারপর শনিবারের বারবেলার বিষম আবর্তে কক্ষচ্যুত হয় মহারাণা ইলতুৎমিশ। এক হাতে খোলা ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রাজপথে, বা রান্নাঘরে।

-“ক’টা আলু কাটব?”

-“বড় দেখে দু’টো।”

-“তোর খোসাছাড়ানিটায় ধার নেই আর।”

-“ইফ ইউ কান্ট ডান্স, ইয়োর উঠোন মাস্ট বি স্লান্টেড।”

-“তোর বাবা স্লান্টেড। ছুলে দে না আলুগুলো। আমি কেটে দিচ্ছি।”

-“পারছি না। পুর বানাচ্ছি কচুরীর।”

-“পুরনারী কোথাকার!”

-“কী বললি তুই আমায়?”

-“ডোন্ট ব্রিং এ বেলনা চাকি টু এ নাইফ ফাইট।”

 

রণোদ্যত ইবন বতুতা বেলনাটাকে নামিয়ে রাখে। চাকির উপর পেতে রাখা কচুরীর পেটে পুর ঠোসে। মুখের উপর থেকে চুল সরাতে গিয়ে কপালে ময়দা লাগে হাত থেকে।

 

-“বলছি কেমন ভাবে কাটব আলুগুলো?”

-“কুচি।”

-“কুচি? আলুভাজা কুচি?”

-“উফ্‌! না! আলুর তরকারির মতন। চৌকো চৌকো।”

-“ও। ছক্কা।”

 

সমস্ত মনোযোগ দিয়ে ঝুঁকে পড়ে সমান মাপের চৌকো তৈরী করে চলে শেষ-বিশ এর ইলতুৎমিশ। যন্ত্রের মতো, কিন্তু কুটির শিল্পের মমতায়।

“গ্রীবা মানে কী যেন?”

ঘাড় না তুলেই জবাব দেয় ইলতুৎমিশ। “ঘাড়। কেন?”

“আর গলদেশ?”

“যেখানে অ্যাস্টেরিক্সরা থাকত।”

“ইয়ার্কি মারিস না।”

“এক ই রে বাবা। ঘাড়।”

“গলদেশ মানে গলা নয়?”

“উঁহু। গলদেশ মানে গলা নয়। কপোল মানে কপাল নয়।”

“হা পোড়া কপোল। তাহলে গলার বাংলা কী?”

“মেল্ট।”

“মস্তকে ময়দা ঢেলে দেবো কিন্তু।”

“কণ্ঠ।”

“কণ্ঠ তো ভয়েস।”

“ভয়েস ও। থ্রোট ও।”

“ও। কণ্ঠ হল থ্রোট। গ্রীবা হল নেক।”

“হুঁ। নেক। কেন বলবি?”

উত্তর আসে না। ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস আসে। আটা-কড়াইশুঁটির গন্ধ আর একজোড়া পুরুষ্টু ঠোঁটের স্পর্শে  চমকে মাথা তোলে মিশ।

“এ’রকম ভ্যাম্পায়ারপনা করছিস কেন?”

একডজন গাঢ় হাঁফ ছাড়ার পর উত্তর আসে।

“গ্রীবা দেখলেই চুমু পায়।”

আরো একডজন। আরো বারো। এবারো বারো।

“তোর নেক নজর ভালো নয়।”

শনিবারের টেবিলে তিন ছক্কা পুট পড়ে থাকে। ভিতরের ঘরে অল আউট জ্বালিয়ে ঘুমোয় মেহেরুন্নিসা। তুঘলক কফি হাউস যাবে বলে এক পাটি জুতো খোঁজে। ছোট্ট ইলতু সেই অপর পাটি নিয়ে পা টিপে টিপে পাঁচিল বেয়ে সদর দরজার উপর কার্নিশে ওঠে। সেখানে বলাই আর কানাই এর রাজত্ব। বলাই দুর্ধর্ষ ডাকাত। কার্নিশ থেকে কাঠ টগরের গাছে লাফ মারে। কানাই এক চোখে অভিযোগ নিয়ে ম্যাঁও ম্যাঁও করতে করতে ইলতুর পায়ে গ্রীবা ঘষে।

বাঁইবাঁই কক্ষপথের দুরন্ত ঘূর্ণি সত্ত্বেও শনিবারগুলো শাশ্বত সংসার হয়ে ওঠে।