বাসরাস্তার উপর বাড়ি। চিনে রেখেছি। কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে রিক্সাস্ট্যাণ্ড। আসার সময় পথে একটা চশমার দোকান, আর একটা রুমালি রুটির দোকান। বাড়ির সামনে একটা আড়াইপ্রান্তরী মাঠ। বাড়ির পিছনে একটা অনেক দূর থেকে আসছি স্যার একটু বসে যাই রেলস্টেশন। প্রান্তিক না সীমান্ত, কী বেশ একটা নাম। সে স্টেশন হয়ে ট্রেন গেলে বাড়ির আয়নাগুলো কাঁপে। আর আয় না গুলো প্রতিধ্বনিত হয়। আয় না রে। একটিবার। চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে নামছে রবিনহুড। আগাছার জঙ্গল আর মনা পাগলির কুঁড়েঘর পেরিয়ে ছুটছে। ছুটছে তো ছুটছেই। তারপর সাআদা ধবধবে বিছানার চাদর এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো বাঁধা, দোতলার বারান্দা থেকে ঝোলানো। তাই বেয়ে উঠে পড়ছে। উরিব্বাবা।
বিন্ধ্য পর্বত খুব প্রিয়। বিন্ধ্য। কিষ্কিন্ধ্যা। সবচাইতে প্রিয় মৈনাক। ঘাপটি মেরে থাকে কেমন। ডুবে ডুবে জল খায়। আমি মৈনাক। আমি ডুবে ডুবে জল খাই। জুনিপারের জঙ্গলে একটা লুকোনো পুকুর আছে। স্যাটেলাইট থেকে দেখা যাবে না। ভেবেছ কী? হেলিকপ্টার করে উপর দিয়ে ভুটভুটিয়ে বেরিয়ে যাবে, আর তাতেই সব দেখা হয়ে গেল? অভিযাত্রীরা কি বানের জলে ভেসে এসেছে? অনেক পুণ্যি আর পরিশ্রম করলে তবে সেই পুকুর পাওয়া যায়। যক্ষে পাহারা দেয়, জানো? একবার ঢুকতে গিছলাম সে বনে। সন্তর্পণে। তারপর অতর্কিতে থাবড়া। বাপরে। আজকাল প্রবেশাধিকার পাওয়া গেছে। বনের মধ্যে সুঁড়িপথ। মাথার উপর গুল্মের ছাতা। টুকটুক পায়ে হেঁটে দক্ষিণ বরাবর নামতে থাকলেই। পা হড়কে যেতে পারে ঘাটে। সাবধান। আমি আজকাল আর পুকুর থেকে বেরোই না। ওখানেই আছি। গলা অবধি ডুবে। মৈনাক পাহাড়ের মতো। কঠিন তপস্যা।
বাড়ির ছাদ থেকে পশ্চিম ঘাট দেখা যায়। সবুজ পাহাড়ের উপর থেকে মেঘগুলো পিছলে পিছলে নামে। জানলা খোলা থাকলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তারপর পশ্চিমদিকের জানলা দিয়ে বেরিয়ে যায় আবার। মেঘ না থাকলে আরব সাগর দেখা যায়। সন্ধের দিকে সবুজ পাহাড়টা কালো হতে থাকে। ঘন নীল। গাঢ় নীল। কালো। তারপর এক পুটকি দুই পুটকি আলো জ্বলতে শুরু করে পাহাড়ের গায়ে। বাড়ির ছাদেও ও’রকম টুনি টুনি আলো আছে। হলুদ আলো। ছাদে মাদুর। মাদুরের উপর বালাপোশ। বালাপোশের উপর খয়েরি ছিটের চাদর। বৃষ্টি নামলে চিলেকোঠায় ঢুকিয়ে রাখতে হবে। গেল বার আমি রেখেছি। এবার তোর পালা। মনে থাকে যেন। জুনিপারের গন্ধে একট মহুয়া মহুয়া গন্ধ আছে। ছাদ জুড়ে সেই গন্ধ। মহুয়া মাতায় ঢোলক, দোলে পলাশের নোলক। ঢোলকে এক-দুই-তিন-এক-দুই-তিন। নোলক এখনও পরেনি। নাক ফুটো করা হয়নি। হবেওনা এ জন্মে। এ’টা ঠিক ছাদে শোবার মরসুম নয়। সারারাত হিম পড়বে। নাকের ডগায় শিশির হয়ে জমবে। তখন? পরদিন সকালে মাথা ধরবে। এক দিঘী চা না খেলে সে মাথা ধরা যায় না।
আমি কী নিয়ে থাকি? ছাদ থেকে ঝুঁকি। আরব পুকুরের সীমান্ত থেকে একটা বেখাপ্পা বড় চাঁদ বেরোয় মাঝেমধ্যে। কখনও মানিকদের ইঁটের গুদামে এক ডাঁই বালির উপর রোদ পোয়াতে দেখি কানা বিড়ালটাকে। ওই যে বলেছিলাম না, আড়াইপ্রান্তরী মাঠ? সেই মাঠের একধারে, বাড়ির দিকের ধারে একটা সাদা মারুতি দাঁড়িয়ে থাকে। গত দোলের দিন ভোরবেলা উঠে দেখি কারা যেন রঙ মাখা হাতের ছাপ রেখে গেছে গাড়িটার সারা গায়ে। গোলাপি। বেগুনি। সবুজ। রাত্রিবেলা ট্রেনটার শুধু জানলাগুলো দেখা যায়। ভিতরে আলো জ্বলে তো, তাই। একপাল জানলা হাওয়া কেটে হুশ করে বেরিয়ে যায়। দিতে চাস আমায় ফাঁকি, আমি কী নিয়ে থাকি?