ভিক্ষু রাণাঘাটের স্টেশন রোডে সাইকেল জমা করার দোকানটার সামনে অশ্বত্থ গাছটার তলার বেদীতে বসে ছিলেন। গায়ের পোশাকটা ঠিক গেরুয়া নয়। এক পোঁচ গাঢ় বেশি। লালচে গেরুয়া মেশানো। ভিক্ষুকে দেখে মনে হতে পারে ধ্যান করছেন। সে’রকমই বাবু হয়ে বসা। চোখ ঢুলুঢুলু। মাথা কামানো। ভিক্ষুর বয়স হয়েছে।

শুক্কুরবারের বিকেলটা স্টেশন রোড জমজমাট থাকে। কিন্তু আজকের কথা অন্য। কেন অন্য জানিনা। অন্য। ব্যস। কাল ব্রিগেড বলে রাণাঘাট উজাড় করে সবাই কলকাতা গেছে? হতে পারে। সাইকেলের দোকানটা খালি। কমলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারটা শুধু খোলা। আর সব বন্ধ। এক দু’টো ট্রেন আসছে যাচ্ছে। মেঘলা সন্ধ্যে। সবাই ঘরে ঢুকে দোর দিল সপ্তাহের ক্লান্তি ভুলতে? হতে পারে। সোমবার কীসের একটা ছুটি আছে। প্রবীণ ভিক্ষু ঠায় বসে আছেন বেদীর উপর। অনেকটা পথ এসেছেন। হ্যাঁ। তিব্বত থেকেই। একটু দূরে একটা ল্যাম্পপোস্টের আড়াল থেকে তাকে দেখছে আরও দুই পর্যটক। তাদের চোখে শ্রদ্ধা। দ্বিধা। ছেলেটা কনুই দিয়ে ঠেলল মেয়েটাকে।

“যা না। গিয়ে কথা বল!”

মেয়েটা তাকাল। “তোর এত ইচ্ছে তুই যা না!”

“না। একা যাবো না। তুই ও চল।”

দু’জনে তবু দাঁড়িয়ে থাকে আলোর তলায়। উৎসুক চোখে। ভিক্ষু চোখ মেলেন। ইশারায় ডাকেন। দু’জনে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। ভিক্ষুর পায়ের কাছে গিয়ে বসে। বড় আনচান করা গন্ধ একটা। বড় চেনা। বড় আপন। ভিক্ষু হাসেন।

“নাম কী মা তোর?”

“ইবন। ইবন বতুতা।”

ভিক্ষু এবার ছেলেটার দিকে তাকান।

“আমি ইলতুৎমিশ।” ছেলেটা বলে।

“কী চাই তোদের?”

পথ চাই। ওরা ভাবে। দিশা চাই। জড়তা ভেঙে ইবন বলে, “কল্যাণী কোন দিকে বাবা?” ভিক্ষু হাসেন কেবল। গন্ধটা আরও গাঢ় হয়।

“আসল কথাটা বল না!”

এ ওর দিকে চায়। দু’জনে সমস্বরে বলে, “বাড়ি কোন দিকে বাবা?” ভিক্ষু বজ্রলামার মতো অট্টহাস্য করেন। একটা হুহু হাওয়ায় অশ্বত্থের কিছু পাতা এদিক ওদিক লুটিয়ে পড়ে। চা চলকে চাদর ভিজিয়ে কালো করে দেবার মতন আকাশটা কিছুটা তরল অন্ধকার শুষে নেয়। সাইকেল স্ট্যাণ্ডের হলুদ বাল্বের চিড়িক আলো ঝুপুস করে ভিক্ষুর মুখে এসে পড়ে। ভিক্ষু একটা ডিবে বের করেন ট্যাঁক থেকে। তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে একটু দিব্যদৃষ্টি তুলে লাগিয়ে দেন ছেলেমেয়ে দু’টোর চোখে। ইবন আর ইলতুৎ ঘেঁষাঘেঁষি হাত ধরাধরি করে একটা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকে। ইস্পাতের থামে বরফির মতো সাইনবোর্ডে লেখা বাড়ি। স্টেশন মাস্টারের মুখটা ইবনের বাবার মতো। তিনি একটা টিয়াপাখিকে লঙ্কা খাওয়াচ্ছেন। দু’জনের পিলে চমকে দিয়ে পিছন থেকে ভিক্ষু বলে ওঠেন, “এ’টাই তোমার বাড়ি, ইবন?” ইবন মাথা নাড়ে। দু’পাশে। “এ’টা বাবা মায়ের বাড়ি।” অনাদিকাল ধরে চলতে থাকা মালগাড়িটার ল্যাজে গার্ডের কেবিন দেখতে পায় ইলতুৎ। তার বাবা একটা লাল পতাকা নাড়ছেন। “এ’টাই তোমার বাড়ি?” ট্রেনটাকে ধীরে ধীরে ছোট হতে দেখে ইলতুৎ। এ’টা ডপলারের বাড়ি।

“তবে কোনটা তোমার বাড়ি? কোনটা? কোনটা? কোনটা? পঁচাশি নম্বর সড়কের ধারে যে ছোট্ট গ্রামটায়  চারদিন জিরিয়েছিলে, সেখানে? আমু দরিয়ার পাশের বন্দর শহরটায়? বলো? বলো?”

চটকা ভেঙে সোজা হয়ে বসে ইলতুৎ। ভিক্ষু আর নেই। তার লাঠি আর ভিক্ষের বাটিটা পড়ে আছে শুধু। খোসাটুকু। সে উঠে লাঠির পাশে বসে, ভিক্ষুর মতো করে। এতক্ষণ যে রাস্তার দিকে পিঠ করে ছিলো, সেই লম্বা টানা আদিগন্ত স্টেশন রোড তার দিকে তাকিয়ে থাকে। জ্ঞানের বোঝায় ঢুলুঢুলু চোখে ইলতুৎ হেলান দেয় অশ্বত্থে।

“রাতে কী খাই বল তো?” সে বলে।
“সারাক্ষণ খাবার চিন্তা কেন? এক মুহূর্ত একটু শান্তি দে না!”

“এক মুহূর্ত মানে আটচল্লিশ মিনিট।”

“তোর পা বড় শক্ত। একটুও বালিশ বালিশ নয়।”

ইবন তার কোলে মাথা পেতে শোয়।

painting by Sreedhar Unnamatla.