একেকটা দিন থাকে না? বিকেল অবধি সকাল হয়ে থাকে? সেই যে, দুপুর বারোটার মাথার উপরের তারাটার তেজের সাথে ভোর ছ’টার কোনও তফাৎ থাকে না? বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে মনে হয় গায়ে শ্যাওলা ধরে যাবে? নিঃশ্বাসের সঙ্গে এক খাবলা কুয়াশা আর দু’টো ভূত নাকের মধ্যে সেঁধিয়ে যায়। হ্যাঁচ্চো! একটা মিইয়ে যাওয়া দুনিয়ায় আমাদের বাসা, তাই না? ছাতা গজাবে এবার দেওয়াল থেকে। চামড়া থেকে। ঠিক করেছি রোদ উঠলে গা থেকে ছাল ছাড়িয়ে রেলিঙ এ শুকোতে দেব। কিন্তু রোদ উঠলে তো! সাদ্দিনের বাসি না-কাচা ময়লা মেঘের লেপ। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো মাটিতে পড়ে না, এমন অলপ্পেয়ে, বাতাসে ভেসে থাকে। রাগ লাগে, কিন্তু রাগটাও মিইয়ে যায়। থালায় ভাত-আলুর্তর্কারি নিয়ে উনুনের পাশেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেয়ে নিই, ঘরে গিয়ে বসে খেতে ইচ্ছে করে না। ভাত খাবার পর চানাচুর খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ওই, মিইয়ে গেছে। দাদা বলত সাইলেন্সার চানাচুর। চিবোলে শব্দ হয় না। দাদা জানে কারণ এ সাইলেন্সার বন্দুকের নয়, গাড়ির। দাদা গাড়ি চালায়। কোম্পানির গাড়ি। এদেশ ওদেশ। দাদাও ভূতগুলোকে দেখতে পায়। আমায় বলেছে। জলের বিন্দুর সঙ্গে ভেসে থাকে। গাড়ি জোরে চললে পোকার মত সামনের কাচে এসে থেবড়ে যায়। দাদা ওয়াইপার দিয়ে পরিষ্কার করে দেয়। কিন্তু আমার যে নাকের মধ্যে…
পৃথিবীতে যত বাজে গন্ধ আছে, তারমধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় বিড়ির গন্ধ। সহ্য করতে পারি না। চোখে জল চলে আসে। তবু নীচতলায় কেউ বিড়ি খেলে আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। আজকে বিড়ির ধোঁয়াটা মেঘ হয়ে আছে। একটা গোল সাদা বৃত্ত হয়ে নাকের সামনে ঘুরঘুর করছে। ভেঙে, গলে, মিলিয়ে যাচ্ছে না। স্থাণু হয়ে আছে। ভরহীন। আমি পারব না ওরকম উড়ে থাকতে? পায়ের আঙুলগুলো সবুজ সবুজ হয়ে যাচ্ছে। মেঝেতে শ্যাওলা হলে এড়িয়ে থাকা যায়। পায়ের তলাতেই যদি শ্যাওলা গজায়, মানুষ কী করবে? একেকটা দিন থাকে না? একটু শুকনো কিছুর খোঁজে প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে? হাতের চেটোয় আঙুলের চামড়া কুঁচকে যায়? রাস্তায় ছাতা গজায়? চলমান ছাতা। কালো। সাদা কালো। লাল। ফুটকি দেওয়া। ছাতা। সব ছাতার তলায় মাথা আছে কিনা বোঝা যায় না উপর থেকে দেখলে। নাই তো থাকতে পারে। মাথা থাকতেই হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? এই যেমন আমার ঘরের দরজার সামনে মেলা ছাতাটা। একদিকে কাত করে মেলে রাখা। ঘরে যাতে জল না পড়ে। ছাতাটা যাতে শুকোয়। শুকোবে! সেই! নাকের মধ্যে ভূত দু’টো যেন শুকনো লঙ্কা পোড়ায়। হ্যাঁচ্চো। ধিকিধিকি রাগটা একটা ফুলকি দিয়ে জ্বলে ওঠে। সূর্য্যটা দিতে বলছি তো? বলছি তো দিতে? দিবি কিনা? দশ গুনব। উবু দশ কুড়ি ছাড়িয়ে শয়ে পৌঁছয়। ম্যানহোল থেকে একটা কুমীর মাথা তোলে, কিন্তু সূর্য্য আর আসে না। শোন না, রোদ উঠলে তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবো। পাইন পাহাড়ের মাথায়। গত শতাব্দীর বাসিন্দারা ওখানে রোদ পোহাতে যায়। কুশল বিনিময় করে। ছোট ছোট বাড়ি আছে ওদের। মাটির তলায়। ফলকে নাম লেখা। বাগানবাড়ি। ওরা অন্যকোথাও থাকে। অন্যকখনও। অন্য সময়ে। রোদ উঠলে রোদ পোয়াতে আসে ওখানে। নিয়ে যাবো। ফলক ফাঁকা থাকলে আমরা শুয়ে শুয়ে রোদ পোহাবো। পাইনের গন্ধ ভারী মিষ্টি। সবুজ রঙের গন্ধ। হাল্কা সবুজ। একটু আকাশি। রোদ না উঠলে গন্ধ বেরোয় না। একটা গান খুব ভাল্লাগে। Pining away in the cold shrouds there, hoping the sun won’t be long। কার লেখা জানিনা। আমারও হতে পারে। সুরটা মনে আছে। শুধু এই দু’টো লাইনের সুর। কথাগুলো কী এ’রকম ছিলো?? নাকি আমি বদলে নিয়েছি?
তারপর সকাল-দুপুর-বিকেল-সকালটা শেষ হয়ে যায়। ময়লা আকাশটা কালো হয়ে যায়। রাস্তা ঝলমল করে দোকানের আলোর প্রতিবিম্বিত রোশনাই এ। বৃষ্টিফোঁটার পর্দা পেরিয়ে রাস্তায় নামি। নোংরা বাড়ির ঝুলের মত মুখে চোখে আটকে যায় বাষ্প। বেঞ্চিতে বসতে গেলে প্যান্ট ভিজে যাবে। তরল আয়নায় পা পড়লে মোজা ভিজবে। নিজেকে একটা বয়ামের পেটের মাছ মনে হয়। তুঁতে রঙের মাছ। ইলতুৎমিশ। আমিও মাছ। তুইও মাছ। কেমন? আমি ইলতুৎমিশ। তুই ইবন বতুতা। হাঁটু অব্দি প্যান্ট গুটিয়ে জুতো বগলে মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়াই।
সেইখানে, সেই মোড়ের মুখে মুখোশ বেচে একটা লোক,
সুখের মুখোশ, মূকের মুখোশ, মুখের মতই দেখতে হোক…
সেই মোড়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে, মুখোশ কেনার পয়সা নেই,
পথদুটো তাই বন্ধ রাতে, ফিরছে সে দ্যাখ, তোর দিকেই…
Silencer lagano chanachur ta asole Kamu Mukherjeer kotha, ekei bole shooting ey achhe.
LikeLiked by 1 person
জানা ছিলো না। 🙂 ধন্যবাদ! লেখাটা কেমন লাগল জানাবেন…
LikeLike