ঢ্যাঙা বাতিগুলো থেকে গোল হয়ে আলো পড়েছে রাস্তায়। চাকা চাকা আলো। খুঁটি গুলো বেশ দূরে দূরে। চাকাগুলোর মধ্যে অনেকখানি অন্ধকার। সেই অন্ধকারটুকু বিশালাক্ষী দৌড়ে পেরিয়ে যায়। তারপর আলোটুকু হাঁটে। রাস্তা ফাঁকা। একেবারে ফাঁকা। গা ছমছম করে। এমনিতে বিশালাক্ষী খুব সাহসী। হাওয়াই চপ্পল দিয়ে গালি দিতে দিতে আরশোলা মারতে পারে। নিজের ঘরে আলো জ্বালাতে হয় না ঘুমোনোর সময়, খাওয়ার ঘরে জ্বললেই দিব্যি ঘুম এসে যায়। গতকাল একটা পায়রা এসে বাথরুমে আটকে পড়েছিল কীভাবে। বিশালাক্ষী কি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল? না! সে অফিস অবধি হিসি চেপে রেখেছিল। ফিরে এসে দেখেছিল পায়রাটা নেই। নির্ঘাৎ কাজের মাসি এসে উদ্ধার করেছে। জিজ্ঞেস করা হয়নি।

হিসেব অনুযায়ী আর চারটে খুঁটি পেরোনো বাকি। তারপরেই ফ্ল্যাটের গেট। এই সময়টুকু কেউ থাকলে সঙ্গে ভালো লাগত। হাওয়ায় অল্প ঠাণ্ডা। তারা দিনের বেলায় কোথায় থাকে কে জানে। কারিপাতার গন্ধ। কারিপাতা। সর্ষে। বিশালাক্ষী একটু দাঁড়ায়। একটা আলোর চাকার কেন্দ্রে। কারিপাতাটা আসল। সন্দেহ নেই। সর্ষেটা আদৌ আছে, নাকি সারাজীবন কারিপাতা আর সর্ষে একসাথে শুঁকে এসেছে বলে ধরে নিচ্ছে যে রয়েছে? তারপর পিছন থেকে একটা দমকা হাওয়া তার চুলগুলো কে সামনে এনে দেয়। পাতাগুলো ধাক্কা খেতে খেতে এগোয়। চুল সরিয়ে পিছনে তাকায় বিশালাক্ষী। ওটা কি ছায়া? পিছনের ল্যাম্পপোস্টের নীচে? বাবাগো। ব্যাগ আঁকড়ে ফের দৌড় লাগায় বিশালাক্ষী। কেউ একটা হেসে ওঠে কোথাও।

হাওয়ার জোর বেড়েছে। পাক দিচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। দিক গুলিয়ে যাচ্ছে। চটি ফটফট করছে। পায়ে জড়িয়ে পড়ে আর কী! চোখে ধুলো ঢুকবে এবার। ঝড় মতন উঠছে। বিশালাক্ষী সবার বাপান্ত করে। সবার। পায়রাটার। কারিপাতার। কাজের মাসির। অটোওলার। চাকরির। বাড়ির। ল্যাম্পপোস্টের। যে কুকুরটা রোজ কমলা ফ্ল্যাটটা থেকে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে, তার। অসহ্য! রোজ তাকে খিস্তিয়ে থামানো যায় না। ফ্ল্যাটের নীচ দিয়ে গেলেই পিলে চমকিয়ে ডেকে ওঠে, আর আজকেই… বাঁ দিকের সাদা ফ্ল্যাটের তিনতলার জানলায় চোখ পড়তেই বুক ধড়াস করে ওঠে বিশালাক্ষীর। কালো বিড়ালটা বাড়াবাড়ি রকমের শান্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পা থেকে চটি খুলে ছুঁড়তে ইচ্ছে হয় বিশালাক্ষীর। এই বিড়ালটা মানুষ না। মানুষ না। অপদেবতা। যেখানে চোখ পড়বে সেখানে ও! সর্বত্র। আর সবসময় এ’রকম স্থির হয়ে বসে থাকবে। বিশালাক্ষীকে দেখা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই বিড়ালটার। চোখের দিকে তাকালেই পায়ের তলায় সুড়সুড় করে। ওই ঘরের মোটকা মহিলাকে বলেওছিল। সে “ও বিড়াল আমাদের না, ও’রম বিড়াল দেখিনি” বলে কাটিয়ে গেছে।

তালাটা খুলতে অন্যদিনের থেকে বেশি সময় লাগল। স্বাভাবিক। তালাটাকেও খিস্তি করে মেয়েটা। তারপর ঘরে ঢুকে দরজাটা পিছনে বন্ধ করে নিঃশ্বাস ফেলে। চটি খুলে, ঘড়ি টেবিলে, ব্যাগ মেঝেতে, ওড়না হাওয়ায় ভাসিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। একটা খুব জাগতিক, সাধারণ, সোজা রাস্তাই তো। তা বই তো কিছু নয়। কোনও অতিপ্রকৃতি নেই। সার সার ফ্ল্যাটবাড়ির মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া একটা সোজা রাস্তা। শুধু রেলিং এর উপর একটা পায়রা। পায়রা! বিশালাক্ষী হাতের কাছে কিছু না পেয়ে এমনিই তেড়ে যায়। ঘরে ঢুকতে দিলে চলবে না। পায়রাটা রেলিং ছেড়ে বাঁ দিকে দেওয়ালের পিছনে অদৃশ্য হয়ে যায়। ওদিকে বারান্দার সঙ্গে লাগানো শোবার ঘরের জানালা। তারপর বাথরুম। বিশালাক্ষী ঝুঁকে দেখবার চেষ্টা করে পায়রাটা তার কোনও একটা দিয়ে ঢুকল কিনা। মাথা বাড়িয়ে অচল হয়ে যায় সে। পায়রাটা বাথরুমের জানালার ঠিক নীচের কার্নিশটায় মরে পড়ে আছে। গলার কাছটা খাওয়া। বিশালাক্ষী সভয়ে পিছিয়ে আসে। এক্ষুণি কাকে দেখল? সে পায়রাটা কই? সে আরেকবার মাথা বাড়ায়।

পায়রাটা এখন দুই পায়ে দাঁড়িয়ে। ওই কার্নিশেই। পাশে কোনও মরা পায়রা নেই। পাশে যেটা রয়েছে, সেটা একটা কালো বিড়াল।

বিশালাক্ষী দৌড়ে ঘরে ঢোকবার চেষ্টা করে। বারান্দায় শুকোতে দেওয়া ঝুলন্ত কামিজে মুখ জড়িয়ে যায়। সে হাউমাউ করে ঘরের মধ্যে এসে হোঁচট খায়। মাটিতে পড়ে না। কেউ তাকে ধরে নিয়েছে।
“এসেছিস বলিসও নি!” কাঁদো কাঁদো হয়ে বিশালাক্ষী বলে। ফটিক হাসে। “আমি মরে যেতে পারতাম তুই জানিস? তুই জানিস? একের পর এক ভুলভাল জিনিস দেখে যাচ্ছি!” ফটিকের হাসি চওড়া হয়।

“কী দেখলি?”

বিশালাক্ষী মারতে উদ্যত হয়। “এক মারব হাসলে। পায়রার ভূত দেখলাম। বিড়ালের ভূত দেখলাম-!”

“ব্যস?!” ফটিক হাসে, “ঘেঁটুরামের দৌড় ঐটুকু?”

বিশালাক্ষী তাড়া করে। ফটিক দৌড়ে পর্দার পিছনে লুকোয়। বাইরে থেকে সেই দমকা হাওয়াটা ঢোকে। পর্দা ওড়ে। খালি। একেবারে খালি।

হাওয়ায় কেউ হাসে।