রাত অবধি ধুম জ্বর ছিলো। ওষুধ খেয়ে ঘুমোতে গেছি। কাল ইস্কুল আছে। আমাদের পাড়ায় খুব মশা। মশারির ভিতর দিয়ে পাখার হাওয়া এমনিই আসে না, তার উপর পাখা দুই তে দেওয়া। কারণ, ঠাণ্ডা লেগে জ্বর। এদিকে মাঝরাতে জ্বর ছেড়েছে ঘাম দিয়ে। ঘুম ভেঙেছে। উশখুশ করছি। এমন সময় নাকের উপর ভীষণ ভারী কী একটা এসে পড়ল। বুঝলাম, একটা হাত। মায়ের হাত। মায়ের শাঁখা বালা চুড়ি ওলা বিশাল হাত। আমার নাকের উপর। সে নাক ফাটার জোগাড়। এদিকে হাতটা হাতড়ে হাতড়ে কপালে এসে পৌঁছেছে। মা ঘুমের মধ্যেই আমার জ্বর আছে কিনা দেখছে।
আমার মা টা এমনি ক্যাবলা! গাছতলার ব্রিজের উপর বিচ্ছিরি জ্যাম। রিকশার চাকা মাটি ছুঁয়েছে কার অভিশাপে। ট্র্যাফিক পুলিশটা হদ্দ বোকার মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার আবার পরীক্ষা। ইস্কুলে। মা বলতে গেছে গুঁফো পুলিশকে, “একটু দেখুন না দাদা।” কথা। কথার পিঠে কথা। ঝগড়া। মা ভ্যাঁক করে কেঁদে দিলো। এমনি ক্যাবলা আমার মা। যত হম্বিতম্বি আমার উপর। জ্যোৎস্না মাসি বঁটিতে চিচিঙ্গে কাটতে কাটতে স্থাণু হয়ে গেছে। হাত চিচিঙ্গের দুই ধারে, চিচিঙ্গের পেটে বিঁধে বঁটি। মাসির হাত নড়ে না। তাকে ঘিরে আমার আর মায়ের যুদ্ধ চলছে। তিনশো ছাপ্পান্নতম অরবিন্দ পার্কের যুদ্ধ। মায়ের হাতে খাপখোলা বেলনা, আমার ঢাল চাকি। কী ছড়িয়েছিলাম, কে জানে? এমনি বীর আমার মা। আলুভাতে মাখতে মাখতে সিরিয়াল দেখতে দেখতে জলের বোতল ভেবে সর্ষের তেলের বোতল গলায় ঢালে!
ইস্কুলে যাচ্ছি। খুব ছোট তখন, নার্সারি। নাকতলা মিনির জানলার ধার। মায়ের কোলে। এমনি ক্যাবলা আমার মা, হাত গলে জানলা দিয়ে ব্যাগ গেল রাস্তায় পড়ে। পাশের আরও খোকা, আরও মা’রা ছিলো। তাদের কাছে আমায় গছিয়ে দিয়ে “ওদাদা একটু থামান!” বলে নেমে পড়ল রাস্তায়। ব্যাগ তখন অনেক পিছনে, বাস আর দাঁড়ায়? আমি এমনি ক্যাবলা, তারস্বরে কান্না। বাড়ির বাইরে সবটা অচেনা তখন। শত্রুপুরী। হোস্টাইল টেরিটরি। সারা ইস্কুল ভয়। আমার অচেনা মানে তো মায়ের ও অচেনা, না? এমনি ক্যাবলা আমি। মা যদি হারিয়ে গিয়ে থাকে? আর যদি মাকে দেখতে না পাই?
তারপর একটা সময় সেই টেরিটরির সীমারেখা পিছোতে লাগল। পিছোতে পিছোতে একেবারে আলাদা মহাদেশ। খুব অনেক কিছুর তলায় লুকোনো সেই ভয়টা এখনও বিদ্যমান। তাকে পেলেপুষে বড় করছি নিজেরই অজান্তে। এমনি ক্যাবলা আমি।