কত বোতাম হারিয়ে যায়। তাদের আয়ু ফুরোয়। কারুর অকালমৃত্যু হয়। সবথেকে বয়স্ক বোতামদের জায়গা হয় জামার কলারে। কেউ তাদের খুব একটা খাটায় না। ঘাঁটায় না। আপিস বাবুরা টাই পরবার আগে তাদের বুকের কাছে দাঁড়িয়ে, কখনও গোড়ালি উঁচু করে কলারের বোতাম আটকে দেয়। ছেলেপুলে শ্বশুর শ্বাশুড়ি জা ননদ ভাসুর ভর্তি বাড়িতে সেই একটু ভালোবাসাবাসি। বাড়ি ফিরে ঘেমো কলারে টান পড়ে। একটু একটু করে আলগা হয় বোতাম। একদিন ছিটকে পড়ে।
আমি বোতাম হারিয়ে এলে মায়ের বকা খেতাম। ভিতরের ঘরের কাঁচের শোকেসে একটা হলুদ কৌটো ছিল। তাতে এ’রকম কুড়িয়ে পাওয়া অনাথ বোতাম থাকত। তাদের মধ্যে থেকে সবচেয়ে রঙ মেলে যেই বোতামের, সেইটা যত্ন করে সেলাই করে দিত মা। বোতামের পুনর্বাসন হত। অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নিত জামা। জামাজোড়া সাদা বোতামের সাথে একটা বাদামি। আমার খুব ভালো লাগত। ভাবতাম, গেঞ্জিরা বোতামের শ্রেণীশত্রু। গেঞ্জিরা। প্যান্টের হুক’রা। পাঞ্জাবির বোতামরা আলাদা থাকত। বোর্ডিং ইস্কুলে। মা ধোপার কাছে দেবার সময় বোতামগুলো খুলে সেই হলুদ কৌটোতে রেখে দিত। বিয়েবাড়ি যাবার সময়, বা পুজোর সময় সে পাঞ্জাবি পাট ভেঙে বেরোলে বোতামরা বাড়ি আসত।
কিন্তু, মৃত বোতামরা কোথায় যায়? মৃত বলগুলো কোথায় যায়? কোনওদিন বুকের উচ্চতার বল সাহসী হুক মারলে পাঁচিল টপকে সাহাদের ইঁট গুদামে গিয়ে পড়ত। আর পাওয়া যেত না। কাউ-কাউকে পাওয়া যেত। তারা নর্দমায় আধডুবো। রেসকিউ অপরেশন চালিয়ে তাদের উদ্ধার করা হত। তারপর ধুলোয় ঘষে, বা কলের তলায় ধুয়ে পুনর্জীবন। সেদিনগুলো রুটি আলুভাজা খাবার আগে সাবান দিয়ে হাত ধুতে মনে করিয়ে দিতে হত না। বাকিরা? সাহাদের ইঁট বালি লাগোয়া ঘাসজমি একবার সাফা হয়েছিল সাপের উপদ্রবে। চাঁচাপোঁচা মাঠ তখন। মাকুন্দ এক ফালি জমি। তবু হারানো বল’দের দেখা মেলেনি। তবে তারা কোথায় যায়? হারানো বোতামরা? কোথায় যায়?
বোতাম। উপরেরগুলো খুলে রাখলে অসভ্য। বেলেল্লা। লোফার। এদিকে বাবা শরীর ঠিক রাখবে বলে যাদবপুর থেকে বাড়ি হেঁটে আসে। হুড়মুড় করে হাঁটে। রিকশার মত জোরে। বুক পিঠ ঘামে জবজব। বাড়ি ফিরলে দেখি তিনটে বোতাম খোলা। তখন? তখন? ব্যস। আমিও টিউশন থেকে ফেরার সময় বাসের পাদানিতে তিনটে বোতাম খুলে হুহু হাওয়া বুকে নিয়ে ফিরতাম। বাসস্ট্যান্ডে নেমে লাগিয়ে নিতাম আবার। তাড়াহুড়োয় দুই এর বোতামটা তিনের ঘাটে চলে যেত। বোতামের ব্যাভিসার। তিনেরটা বেখাপ্পা বেরিয়ে থাকত। “একটা বোতামও লাগাতে শিখিসনি ঠিক করে”।
তারপর একদিন ইস্কুল যাবার সময় দেখা যেত তিনের বোতামটা আত্মহত্যা করেছে। রাগে। দুঃখে। অভিমানে। মা ভিতর থেকে সেফটি পিন দিয়ে আটকে দিত। টিফিনটাইমের অহেতুক কুমিরডাঙার সময় সেই সেফটিপিন ফুটত বুকে। তখন মনে পড়ত, তিনের বোতামটা গেল কই? হ্যাঁ? কই গেল? আর ওর দুই এর বোতামটা? একদিনও কি হাভাতে প্রেমিকের মত আনন্দের আতিশয্যে একটানে ওর বোতামের জামাত্যাগ করাইনি? তারপর কাঁচুমাচু মুখ করে স্যরি বলিনি? সেদিনের মত কি একটা তুচ্ছ বোতামের শোকে অমন দূর্মুল্য প্রেম প্রেম ভাবটার জলাঞ্জলি হয়নি? তারপর ও পিঠের ব্যাগটা সামনে ঝুলিয়ে বাড়ি যায়নি? গেছে তো?! কিন্তু বোতামটা কোথায় গেল? আঁতিপাঁতি করে খুঁজলাম তো। কোথায় গেল?
আজ উত্তর মিলল।
(ছবিটা একটা পরিত্যক্ত বোতাম কারখানার বলে দাবী করা হয়েছে। আমি মানিনা। আমি কম করে নিজের ছ’টা বোতাম এই ছবিতেই দেখতে পাচ্ছি। আর ওর একটা।)