প্রবাস একটা আজব জিনিস। মানুষকে দিয়ে এমন অনেক কিছু করিয়ে নেয়, যা সে বাপের জন্মে করবে বলে ভাবেনি। এমন অনেক কিছু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যার দিকে সে আগে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছে, কিন্তু খেয়াল করেনি। সে মানুষ বরাবর ফালি করে কাটা আলুভাজা খেয়ে এসেছে সন্ধ্যেবেলা, গরম রুটি দিয়ে। তার দিব্যি লেগেছে। কিন্তু মানুষটা কখনও খেয়াল করেনি যে আলুর গায়ে লেগে থাকা কালো জিরের বিন্দুগুলো না থাকলে সে স্বাদ আসত না। এখন প্রবাসে কড়ার মধ্যে সাদা তেলে সেই কালোজিরের বুড়বুড়ানি দেখে তার বোধোদয় হয়। মাসি চণ্ডীগড় থেকে ফোন করে মায়ের কাছে পুঁইশাকে কী কী দেয় জানতে চাইত, এখন সে মানুষটা সেই মাকেই তুর্কী শাকশুকা বানানো শেখায়। হয়, হয়। এ’রম হয়। প্রবাস কাকে বলে তো জানো না! যেদিন পুরোনো স্কচব্রাইট বাতিল করে নতুনটা দিয়ে নিজের এঁটো বাসন মাজার পর মনটা ফুরফুরে হয়ে যাবে, সেদিন বুঝবে।
আজকে বিকেলবেলা নাছোড়বান্দা কিছু ভাল্লাগেনা জাঁকিয়ে বসেছিল। একটা বই লিখব ঠিক করেছি। ভাল্লাগছেনার অসহ্য অধ্যাবসায়। দি আনবিয়ারেবল পারসিস্টেন্স অফ ভাল্লাগছেনা। কোথাও যাবার নেই। কাজে মন বসছে না। একটা ভালো কিছু দেখার নেই। গল্পের বই এর অক্ষরগুলো আউট অফ ফোকাস হয়ে যাচ্ছে। বাঁশিগুলো বিরক্তিকর রকমের ফ্যাঁসফেঁসে শোনাচ্ছে। পকেটে হাত দিলেই কিলবিলে দুচ্ছাই। হুলিয়ে মদ খেতে ইচ্ছে করছে। দেশে এখন রাতভোর। ফোন করলে হাজার ডলারের টিকিট কেটে উড়ে এসে কেলিয়ে যাবে। এখানকার মানুষগুলো ছায়া হয়ে গেছে। সেই ছায়াদের নম্বর ঘোরাতে থাকি। বরবউ কোন চুলোয় প্রেম করতে গেছে। এক মক্কেল পা ভেঙে শয্যাশায়ী। একটা মার্কিন ছায়া এক্টোপ্লাজম ধারণ করে মুখর হল। ল্যাংড়া কানাই কে ঘাড়ে করে তার বাড়ি গেলুম। তার বাড়ি তো নয়, মিনার্ভার বাড়ি। চারটে মানুষ, একটা কুকুর, একটা বিড়াল, আর মিনার্ভা। মিনার্ভা বিড়াল নয়। কারণ আমাকে কাউচে শুয়ে গড়িমসি করতে দেখে সে সটান আমার বুকের উপর উঠে বসে আমার গাল চেটে ঘরঘর শব্দ করে ঘুমিয়ে গেছে। ওর গোঁফে আমার হাঁচি আসছে। হাঁচতেও পারছিনা, আমার প্রকাণ্ড ভুঁড়ি দুলে উঠলে মিনার্ভাদেবী রুষ্ট হবেন। মেয়েমানুষের এত বড় গোঁফ ভাল্লাগেনা। কিন্তু বাড়ির কর্ত্রী, কিছু বলা তো যায় না। বেশ খানিকক্ষণ এরকম চলছিল। হেঁসেলে মার্কিন ছায়া আর তার হিন্দুস্তানী বউ মাছ রান্নার তোড়জোর করছিল। ল্যাংড়া কানাই টেবিলে বসে চোখের জল ফেলতে ফেলতে পেঁয়াজ কাটছিল। আমি মিনার্ভার তলায় চাপা পড়ে ছিলাম। তারপর বেয়াক্কেলে কুকুরটা সোহাগ করতে এলো। মিনার্ভা একটা আট দশমিক দুই সিক্কার থাপ্পর কষাল কুকুরটাকে। তারপর আমার বুকের উপর থেকে নেমে জানলার পাশে বসে বাইরে বৃষ্টি দেখতে লাগল। আমি উঠে রান্নাঘরে এলাম।
শ্যামভজনের গিন্নী আমায় আলসে বলে চার কথা শুনিয়ে একতাল আটা মাখা ধরিয়ে দিয়ে বলল লেচি করতে। আর বেলতে। রুটি হবে। আমি মহানন্দে আটার তাল থেকে খিমচে নিয়ে গোল্লা তৈরী করতে করতে, আর সেগুলোকে পিষে মোজাম্বিকের মানচিত্র বানাতে বানাতে উপলব্ধি করলাম ব্যাপারটা। প্রবাস রুটি বেলার মত দিশি দৈনন্দিন কাজকেও কেমন অমূল্য করে তোলে। রাইকিশোরী হুইস্কি না, ডাউনটাউন মহল্লার মোচ্ছব না, কেবল কয়েকটা ব্যাঁকাতেড়া রুটি গপ করে ভাল্লাগছেনা গুলোকে গিলে খেলো। মা’কে মনখারাপের দিনে রুটি করতে বললে মা ঝাঁটা নিয়ে তাড়া করবে।
হাতের আটা মিনার্ভার গায়ে মুছে দিলাম। শ্যামভজনের গিন্নী রুটি সেঁকছে। ভেজা বাতাসে সেই গন্ধ আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করছে, “শেষ কবে হাত-রুটি খেয়েছ, মনে পড়ে?”
iye, shyamvojon na janle-o amra to jani shyamvojon er ginni sombondhe ki bola ache. Je ruti khawache take eirokom bodnaam kora ki thik ?
LikeLike
Raambhojon er ginni chhilo sheta.
LikeLike
Thik bolechen, amar i bhul. Ek haat naak-khot diye dilum.
LikeLike